মহসিন কবির: রাজনীতির বড় শক্তি বিএনপি। নির্বাচনে তাদের চ্যালেঞ্জ দিতে প্রস্তুত হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল। ধর্মভিত্তিক দল ছাড়াও এই জোটের শরিক হতে পারে মধ্যপন্থিরা। গুঞ্জন আছে এনসিপিকে জোটে ভেড়ানোরও। তবে জামায়াতের সভা-সমাবেশে যোগ দেয়াকে নির্বাচনী নয় বরং সংস্কারেকন্দ্রিক জোট বলছে তরুণদের দলটি। প্রত্যাশিত জোট হলে নির্বাচনে ভালো ফলাফলের আশা জামায়াতের। আর বিএনপির অভিযোগ, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ নানা দাবি তুলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।
জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, অন্তত ২০টি দলের সমন্বয়ে জোটটি গড়ার জন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা হচ্ছে। জামায়াতের ওই নেতা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে, এমন সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে জোট গঠনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে ভোটের তফসিল দেওয়ার কথা বলছে। এ কারণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এ জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে।
দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া এ দুটি দাবি জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) একেবারেই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ফলে দুই দলেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এখন একসঙ্গে পথ চলার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। ভোটের জোট গড়ার বিষয়ে দুই দলই আলাদা করে বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছে।
জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্রীয় নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু ভোটের জন্যই জুলাই অভ্যুত্থান ঘটেনি। ভোটের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, যা এখনো করা যায়নি। তিনি বলেন, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জুলাই আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের এত আপত্তি কেন সেই প্রশ্নও তোলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় এ নেতা।
জানা গেছে, জামায়াতের নেতৃত্বে মাঠে আসতে যাওয়া এ জোট বিএনপির ভোটের দাবি মোকাবিলা করে রাজনীতি করবে। অবশ্য, বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে যত বাধাই আসুক, নমনীয় রাজনীতি করবে দলটি। প্রয়োজন অনুযায়ী নরম হবে। পরিস্থিতি ডিমান্ড করলে গরম রাজনীতিও করবে বিএনপি।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সুবিধাজনক ফল প্রত্যাশা করছে জামায়াত ও এনসিপি। প্রত্যাশিত ফলাফলের জন্য অন্তত এক বছর সময় দরকার তাদের। ফলে বিভিন্ন ইস্যু দিয়ে নির্বাচনের জন্য আরও এক বছর সময় পেতে চায় জামায়াত ও এনসিপি।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেদাভেদ ফেব্রুয়ারিতে ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। জনমনে অনিশ্চয়তা দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকার বারবার ভোট পেছানো হবে না জানালেও, ভোট নিয়ে অবিশ্বাস দূর করা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটবিরোধী জোটে সব ধর্মভিত্তিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া নতুন রাজনৈতিক শক্তি এনসিপি, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদসহ আরও বেশ কয়েকটি দল থাকবে জোটে। একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে জানায়, জামায়াত চায় এ জোটে কমপক্ষে ২০-২২টি দল থাকবে। সূত্রগুলো আরও জানায়, ভোট না চাওয়া জোট বড় করে তুলতে পারলে সরকারকে চাপে ফেলতে পারবে।
জামায়াত ও এনসিপিসহ একাধিক দল ভোট আটকানোর দাবি জানিয়ে এলেও অন্তর্বর্তী সরকার তা গ্রাহ্য না করায় জোটের পরিকল্পনায় নিয়েছে জামায়াত। তাই ভোটবিরোধী ঐক্য ও জোট গড়ে বড় আওয়াজ তুলে ভোট আটকানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জামায়াতকে সামনে রেখে জোট গঠনের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভোটের তফসিল ঘোষণার আগেই ভোটবিরোধী জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। জামায়াতের নেতৃত্বে এ জোটের দাবি থাকবে ভোটের আগে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, পিআর পদ্ধতি ও গণপরিষদ নির্বাচন। তারপরই হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সূত্র জানায়, উল্লিখিত ইস্যুগুলো সামনে রেখে তারা সবাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে মিলতে যাচ্ছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘দেশ গভীর সংকটে রয়েছে বলে এ সংকট কাটাতে সবাইকে ধৈর্য রাখতে হবে। পরস্পরের প্রতি আস্থা রেখে দেশের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখার রাজনীতি নেতাদের ভেতরে দেখাই যাচ্ছে না। সবাই নিজ নিজ দলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনীতি করছেন। বিশেষ করে জামায়াত, এনসিপি নির্বাচন বিরোধিতায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। আবার বিএনপির নির্বাচনী চাপও অন্তর্বর্তী সরকার আর সামাল দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে বৈঠক করেও সমাধানে আসতে পারছেন না। নির্বাচন ইস্যুতে দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে। সেটি ঘোচাতে না পেরে বিএনপির নির্বাচনের দাবি আমলে নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সেই ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল এক অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করা সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। রাজনৈতিক দল যত বড় তার দায়িত্ব তত বড়। এ নির্বাচন যাতে হয়, সে ব্যাপারে গ্যারান্টি বা দায়িত্ব বিএনপিকে দিতে হবে এবং জামায়াতকেও দিতে হবে। আর যাদের দল আছে তাদেরও দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেদিন ভোট হবে সেদিন যার যেখানে শক্তি আছে, তার যদি মনে হয় যে আমি জিততে পারব না, উনি গিয়ে ব্যালট বাক্সগুলো নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। পুলিশ কি বাধা দেবে? এ প্রশ্নগুলো সমাধান না করে, সংস্কার বলেন আর অন্য যে কথাই বলেন, একটা কথারও মূল্যায়ন হবে না।’
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘দেশ যে গভীর সংকটে পড়েছে, এখান থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দল সবারই এক দাবি হওয়া উচিত নির্বাচন। সেটি দাবি না করে এ-দাবি ও-দাবি কারোর জন্যই মঙ্গলের হবে না।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ছাড়া সংকট কাটানো অসম্ভব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার মাধ্যমে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হবে।’
বিএনপির শীর্ষ আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন এখন নয়, তখন হতে হবে এমন গোঁ ধরা রাজনীতি দেশকে সংকটের মুখোমুখি ফেলে দেবে। সব দলকে প্রাধান্য দিতে হবে নির্বাচন।’