শিরোনাম
◈ আলোচনা চালাতে চান ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা, 'আগ্রাসন' বন্ধের শর্ত ইরানের ◈ সৌদি আরবকে হজের কোটা নিয়ে যে অনুরোধ করলেন ধর্ম উপদেষ্টার ◈ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি আমানতের রেকর্ড: কারা পাচার করল, কীভাবে করল? ◈ যুদ্ধের মুখে ইসরায়েলের নাগরিকদের সুরক্ষা রাখে ‘মামাদ’ কৌশল ◈ গাজায় ‘মানবসৃষ্ট খরা’তে শিশুরা তৃষ্ণায় মৃত্যুর ঝুঁকিতে: ইউনিসেফের সতর্কবার্তা ◈ বাংলাদেশের এক বিভাগের চেয়েও ছোট আয়তনের ইসরায়েলের জনসংখ্যা কত? ◈ সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহার ডিবি হেফাজতে, বেইলি রোড থেকে আটক ◈ এই ইসরায়েল হাসপাতালে ক্ষতির অভিযোগ করেছে, অথচ তারা গাজায় ৭০০ হাসপাতালে হামলা করেছে: এরদোয়ান ◈ তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে প্রস্তুতি চলছে, শিগগিরই ফিরবেন: আমীর খসরু ◈ জাতিসংঘ মহাসচিবের হুঁশিয়ারি: সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে এমন আগুন জ্বলবে, যা কেউ থামাতে পারবে না

প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০১:১২ দুপুর
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০১:১২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাবা: বটবৃক্ষের ছায়া

মাহবুবুল মামুন: ইদানিং বাবার কথা খুব মনে পড়ে বিশেষকরে যখন একাকী মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, দারুণ দুসময়ের মুখোমুখি হয় কিংবা কোন সাফল্যের সংবাদ একাকী বহন করি, মনে হয় বাবা কই। কত মিনিট, ঘণ্টা,দিন, মাস আর বছর পেরিয়ে গেছে বাবার  সঙ্গে দেখা  নেই, কথা  নেই। অথচ ছোটবেলায় উল্টোটি ভাবতাম, মনে হত যখন অবিভাবকত্বের শাসন সরে যাবে, তখন বুঝি সুখের সবটুকু পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে! আমরা সব ভাইয়েরা বাবাকে আব্বা বলে ডাকতাম, যারা বাবা ডাকতো ভাবতাম দূর ওভাবে কেউ ডাকে? ওতে রসকষ নেই! আব্বার ডাক নাম ছিলো খোকা, ছোটবেলায় মা হারানোয় মাতৃস্নেহ বঞ্চিত পরিবেশে বেড়ে উঠাই ভবিষ্যত জীবনে বাস্তবাদী করে তুলেছিলো। মনে পড়ে শৈশবে ছুটির দিন ব্যতীত সরকারি চাকরীজীবী বাবার সঙ্গ পেতাম সন্ধার পর ।

আমাদের প্রতীক্ষাবহুল অপেক্ষা পূর্ণতা পেত আমদের জন্যে কিনে আনা বাহারী মজাদার খাবার হাতে পেলে। কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কড়মড়ি, চিপস, বিস্কিট, সন্দেশ, জিলাপি, উপলক্ষ্য বিশেষে মিষ্টির জন্যে। রাতের খাবারের পর আমাদের পিঠাপিঠি তিন ভাঈকে শুয়ে শুয়ে রাজা-রাণি, হাতি-ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক, রাক্ষস-খোক্ষকসের গল্প শোনাতেন, আমরাও একের পর এক প্রশ্ন করে যেতাম রাজা কেন এত শাস্তি দেয়? বাঘ কি ভাত খায় না? কুমিরের কি ঠান্ডা লাগে না? বাবা হাসতেন! বলতেন বড় হলে বুঝবে একই বস্তু ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। মাঝে মাঝে হালুম-হুলুম, হাও মাও খাও-মানুষের গন্ধ পাও শুনে বাবাকে তিন ভাই একসাথে জড়িয়ে ধরতাম। কখনো কখনো খাবার রান্না করতে দেরি হলে আমাদের সজাগ রাখার দায়িত্বও বাবা গল্প শুনিয়ে পালন করতেন।

ছুটির দিনে সকাল বেলা একজনকে কোলে অন্যজনকে কাধে করে ধানক্ষেত দেখতে যেতেন, মাঠের লোকদের সাথে অনায়াসে আত্মীয়ের মত কথা বলতেন, বাড়ী ঘরের খোজ খবর নিতেন। আমাদের বলতেন ওনি তোমার কাকা হন, দাদা হন, জিজ্ঞেস কর কেমন অছেন?  স্কুলে ভর্তির পর অন্যরূপ দেখতে ও্ বুঝতে শিখলাম। বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা ভয় করত বিশেষত কেউ অন্যায় করলে কিংবা পড়াশুনায় খারাপ করলে ভয়ে সামনে পড়ত না। গ্রামের তো বটেই পরো ঈউনিয়নের এমনকি শহরের কেউ ভালো ফলাফল করলেও গল্প শুনিয়ে আমাদের উৎসাহ দিতেন। এও বলতে ভুলতেন না যে লেখাপড়া করলে ওরকমই করা উচিত আর না হয় ছেড়ে দেয়ায় ভালো ! এক সহকর্মীর ছেলে কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট করলে তাদেরকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন দাওয়াত করে। হয়তো ঈচ্ছা ছিলো আমাদের মনে অবচেতনভাবে ভালো ফলাফলের বাসনা জাগিয়ে তোলা। 

সারাদিন যাই করি না কেন আমাদের উপর অলঙ্ঘ্য আদেশ ছিলো সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরা, আব্বার সাঈকেলের টুংটাং শব্দের জন্য কান খাড়া করে রাখা । আওয়াজ শুনে দৌড়াতাম কে আগে সাঈকেলের কাছে যেতে পারে । মাঝে মাঝে মনে হয় আব্বা বুঝি সেই সাইকেলে করে আবার ফিরবে, দরাজ গলায় আমাদের নাম ধরে ডাকবে, মাজহারুল, মামুন, মাছুম কই তোরা? তিনভাই একসাথে কত হুড়োহুড়ি,মারামারি করেছি তার কোন  ইয়ত্তা ছিলোনা অথচ আব্বার ধমক শুনেই রণে ভঙ্গ দিতাম। যদিও গায়ে হাত তুলেননি বললেই চলে, অথচ আব্বার রুদ্রমুর্তি দেখেই সবার অন্তরাত্বা শুকিয়ে যেত।  স্কুলের ফল প্রকাশের দিন  যত ঘনিয়ে আসতো, মনে শঙ্কা ততই  বাড়ত, ফল খারাপ হলে আর রক্ষে নেই! যদিও সৌভাগ্যক্রমে আমরা পড়াশুনায় ভালো ছিলাম, তবু সতর্ক করার জন্য আমদেরকে শুনিয়ে আম্মাকে বলতেন, খারাপ রেজাল্ট করলে যেন কাল থেকে মাঠে কাজ করি আর না হয় শহরে রিক্সা চালিয়ে খাবার জোটায় । অথচ আর্থিকভাবে অসচ্ছলকে সহায়তা করা, বিপন্নকে পরামর্শ দেয়া, বিশেষকরে শিশুদের জন্য ছিলেন মিশুক দিলখোলা মানুষ। 

ছুটির দিনে আমাদের আনন্দের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিলো পাশের পাড়া/গ্রামের ছেলেদের  সঙ্গে ক্রিকেট খেলা, অব্বার কড়া নির্দেশ , সকাল বেলা না খেয়ে খেলতে যাওয়া যাবে না। অত সকালে আম্মার রান্নাও শেষ হচ্ছে না অবার না খেয়ে যাওয়াও যাচ্ছ না। এদিকে আমাদের যত আস্ফালন আম্মার সাথে, বাহির বারান্দা থেকে আব্বার শব্দ শুনামাত্র সব চুপ । খেলা শুরু হলে দেখতাম আব্বাসহ সব কাক চাচারা হাজির, সবাইকে উৎসাহ যোগাতেন, মাঝে মাঝে দর্শক সারি থেকে ঘোষণা আসত “আজ যে বেশি রান করবে কিংবা বেশি উইকেট পাবে তার জন্য বিশেষ পুরষ্কার”! খেলার প্রতি এমন আগ্রহ মনে করিয়ে দিত কৈশোরে ফুটবল খেলতে গিয়ে আব্বার একটি দাঁত মরে কালো হয়ে যায় । পরে যখন শহরে চলে আসি, সবসময় চাইতেন আমরা যেন গ্রামের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে না ফেলি, ছুটি পেলেই বাড়ি যাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আব্বার আচরন আমাদের সাথে কেমন যেন বন্ধত্বপূর্ণ হয়ে যায়, সাংসারিক জ্ঞান দেয়ার জন্যই বোধহয় হয়তো আমাদের শুনিয়ে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। আমাদের কাছে শুনতে চাইতেন বিশ্ববিদ্যলয়ের গল্প, নতুন কোথা থেকে ঘুরে এলে আগ্রহভরে ওসব জায়গার গল্প শুনতে চাইতেন। প্রতিদিন ফোন করার খোঁজ নেয়ার শেষ হতো কবে বাসায় আসবো সে জিজ্ঞেসায়। যেদিন দাদাভাই আর মাসুম বাড়ি ফিরত, সারাক্ষণ পায়চারি করতেন আর আম্মাকে বলতেন এখন বোধহয় অতদূর এসেছে ! ছোটভাইদের নিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতেন তাদের প্রতীক্ষায়।

 হৃদরোগে যেদিন  মারা যান সেদিন ছোটভাই ডাক্তারি পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছে, পথিমধ্যে বার কয়েক ওর খোঁজ নিয়েছে, পায়চারি  করেছে।  আব্বা মারা যাওয়ার মিনিট দশেক পর তার প্রিয়পুত্র ডাক্তার হয়ে এসেছে  নার্সের এগিয়ে দেয়া প্যাডে আজীবন সংগ্রামী পিতার ডেথ সার্টফিকেট লেখার জন্য । স্কুলে পড়ুয়া ছোট দুইভাই আব্বার লাশের পাশে দাড়িয়ে কাঁদছে, ওরা কি কোনদিন বুঝতে পারবে  কি আকাশসম ছায়া চলে গেছে ওদের জীবন থেকে, বঞ্চিত হয়েছে পিতার শাসন আর স্নেহ থেকে ? বেঁচে থাকতে রেগে গেলে মাঝে মাঝে বলতেন, এখন বুজবি না, যখন থাকবো না তখন বুঝবি, বাবা কি জিনিস ?   এখন খুব বুঝতে পারি কিন্তু সময় তো চলে গেছে, সাধন যে আর হবে না।

লেখক: শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়