অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: মোড়ক পড়ালেই কি আসল হয়ে যায়? যে দেশের স্কুলের শিক্ষকদের এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যান, এমপি উঠতে বসতে অপমান অপদস্ত করেন, দেশের শিক্ষকদের বলছেন, পরীক্ষা না নিয়ে মূল্যায়ন করতে। ওইসব হেডমওয়ালা মানুষদের সন্তানদের মূল্যায়নে ত্রিভুজের জায়গায় চতুর্ভুজ দিলে কি হবে বুঝতে পারছেন? ফিনল্যান্ডের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক কারা হয় জানেন? সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল শিক্ষা বিভাগ’ থেকে মাস্টার্স পাস করা মানুষেরা শিক্ষক হয়। সেই বিভাগে কারা ভর্তি হয় জানেন? অত্যন্ত মেধাবীরা। প্রতি ১০ জন ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে মাত্র ১ জন সুযোগ পায় ওই বিভাগে পড়ার। ওই শিক্ষকদের তো কোনো কাররিকুলামই দেওয়া লাগে না। এমন মানের শিক্ষকের সাথে বছরের পর বছর পুরো একটা দিন করে কাটালে এমনিতেই শিখে যাবে।
আমার ক্লাসের সেরা ছাত্ররা যদি প্রাথমিকের শিক্ষক হতে পারতো তারা যেই ছাত্র তৈরি করতো সেই ছাত্র যদি শিক্ষক হয় সে আরো ভালো ছাত্র বানাবে। এই লুপ ১০ বছর চলে দেশ এমনিতেই বদলে যাবে। আর আমাদের দেশে কোথাও কোনো চাকরি না পেলে শেষমেশ ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়। এরকম স্বপ্নহীন মানুষদের দিচ্ছি আমাদের ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন বুনতে। আমাদের প্রাইমারি কিংবা এমনকি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের জীবনাচার দেখুন তো। কী অমানবিক বেতন, আর কী অমানবিক বেতন? তাদের রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই মর্যাদা দিয়ে শুধু কারিকুলামের নামে সাপের মতো খোলস বদলালেই শিক্ষার মান বদলে যাবে?
সাধারণ মানুষের নানা কারণে বিরোধিতা থাকতে পারে। কিন্তু আমি বিষয়টাকে খুব গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি এই শিক্ষাক্রম চালুর পেছনে উদ্দেশ্য খারাপ। গান, কবিতা, অভিনয় ইত্যাদি মানুষের জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আপনি বলুন তো বিজ্ঞান শেখার আগে কেউ প্রযুক্তি শিখে? বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তি শিখে কেউ প্রযুক্তিবিদ হয় না। হয় টেকনিশিয়ান। জীববিজ্ঞানকে কমিয়ে বিবর্তন তত্ত্ব না পড়িয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন কম পড়িয়ে আমরা কেমন জাতি তৈরি করবো? রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও জীববিজ্ঞানের চেয়ে কি তথ্য প্রযুক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? পৃথিবীর কোথায় এমন আছে? রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞানের চেয়ে কি জীবন ও জীবিকা বেশি প্রয়োজন? রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান গণিত না পড়ে যখন বিজ্ঞান কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবে কি অবস্থা হবে? বিদ্যমান কারিকুলাম কি খারাপ ছিল? বিদ্যমান কারিকুলাম পড়ে আসা কতো ছাত্রছাত্রী পাচ্ছি অসাধারণ মেধাবী। এই কারিকুলাম পড়েই বর্তমান বিশ্বের সেরা পদার্থবিদদের অন্যতম পদার্থবিদ ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে জাহিদ হাসান। দরকার ছিল খেলার মাঠের, দরকার ছিল বেশি করে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের, দরকার ছিল স্কাউটের এক্টিভিটিজ বাড়ানো, শিক্ষকদের মান বাড়ানো। এই কারিকুলাম রেখে শুধু স্কুলের মান বাড়িয়ে শিক্ষার মানের অনেক উন্নতি সম্ভব ছিল।
শেষ কথা হলো সরকারের যদি শিক্ষার মানের উন্নতির ইচ্ছে থাকতো, তাহলে কারিকুলাম পরিবর্তনের আগে গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক কিছু করার যেই লিস্ট আছে সেই লিস্টে থাকা কাজগুলো আগে করতো। যেমন শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বরাত। যেমন শিক্ষকতা পেশাকে উন্নত ও সম্মানিত করতো। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতি উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিতো। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বৃদ্ধি করতো। যেমন প্রতিটা স্কুলে খেলার মাঠ জিমনাসিয়াম থাকতো। সারা বাংলাদেশের প্রতিটা উপজেলায় একটি করে নটরডেম, হলিক্রস, সেন্ট জোসেফের মানের মতো করে স্কুল কলেজ বানান। শিক্ষার মান বিদ্যমান কারিকুলাম দিয়েই উন্নতি করা সম্ভব। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্বব্যিালয়