সাদিয়া নাসরিন: উনিশ বছরের তরুণী কন্যা, আর সতেরো বছরের তরুণ পুত্রের মা আমি। দু’জন ভিন্ন লিঙ্গের সন্তান। এদের আবেগ আলাদা, আনন্দ-বেদনাও আলাদা। আর এদের মাঝখানে হাইফেন হয়ে আছে বারো বছরের একজন কিশোর সন্তান, যামীম। কে না জানে বারো বছর বয়স কতোটা ঘন রহস্যের, সতেরো কিংবা উনিশ কতোটা গভীরতম রসায়নের! এই বয়সগুলো সুন্দর, এই বয়সগুলো ভয়ঙ্কর। এই বয়সগুলো ভেসে ওঠার বা পা পিছলে ভেসে যাওয়ার। তাই বয়সগুলোকে নার্চার করতে হয় খুব সাবধানে, যোগীর সাধনায়, এবাদতের মতো একাগ্রতায়। এরকম তিন বয়সের তিনজন সন্তান আমি একা হাতে মানুষ করছি। একদম একলা হাতেই। না, মানুষ করা বলতে খাওয়ানো পরানো নয়, অভাব/আভিজাত্য শেখানো নয়, পরীক্ষায় স্কোর গুণে তালেবর বানানোও নয়। এমনকি তাদের জন্য উঁচু গন্তব্য ঠিক করে দেয়াও নয়। ‘মানুষ’ করা মানে, সন্তানদের নিজের হাঁটুর উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মতো শরীর আর মনের বল তৈরি করা দেওয়া। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় এবং নিষ্ঠা দাবি করে। সন্তানের সঙ্গে একাত্ম হতে হয়, সিনায় সিনায় যোগাযোগ রাখতে হয়, তাদের ভাষা পড়তে হয়। ওদের নরম মাটিতে মনুষ্যত্বের বীজ রুয়ে দিতে হয়, সেই বীজকে সার পানি দিয়ে চর্চা করতে হয়।
সেই চর্চা আমি নিজের সবটুকু জ্ঞান দিয়ে করেছি। মা হয়ে কন্যাকে মিনিস্ট্রুশেনাল হাইজিন শিখিয়েছি, বাবা হয়ে ছেলেকে ওয়েট ড্রিম ওরিয়েন্টেশন দিয়েছি। সহসাথী হয়ে মানুষের মানবীয় সম্পর্ক, আবেগ, প্রেম-অপ্রেম, কাম-মোহ-যৌনতা নিয়ে অসঙ্কোচে কথা বলেছি। এসব অদৃশ্য দায়িত্বের কথা ছেড়ে দিলেও দৃশ্যমান দায়িত্বগুলোও কম আয়ুক্ষয়ী নয়। দুটো সাম্প্রতিক কাজের কথা বলি। মেয়ে পড়তে যাচ্ছে ভিন্ন দেশে। পুরো প্রক্রিয়াটা এক হাতে আমাকেই করতে হয়েছে। শুধু স্মার্ট বাংলাদেশের এনআইডি করার অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারাই জানেন আমাকে কী কী পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বাকিগুলো নাইবা বললাম। ছেলে ‘ও-লেভেল’ এ্যাসেসমেন্টে বসবে তিনমাস পরে। এখনও তার রেজিস্ট্রেশন হয়নি। কারণ তার বার্থ রেজিস্ট্রেশন ন্যাশনাল সার্ভারে আপলোড করতে ভুলে গেছেন সংস্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সে কারণে তার পাসপোর্ট রিনিউ করা যাচ্ছে না।
ভ্যালিড পাসপোর্ট ছাড়া ক্যামব্রিজে রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না। গত দুটো মাস এই একটা কাজের পেছনে ঝুলে আছি আমি আর আমার চাচা এবং সবচেয়ে বড় আলাপ হলো, আমি কারো ঘাড়ে বসে খাই না। নিজের এবং তিনজন বাচ্চার ভূত-ভবিষ্যতের সংস্থান আমাকে একাই করতে হয়। ন’টা পাঁচটার সিকিউর জবও আমার নয়। একটা মাঝারি আয়তনের প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করি, কনসাল্টেন্ট হিসেবে বিভিন্ন প্রজেক্ট করি। পরিবার-আত্মীয়-সমাজ-লেখাপড়া সব ঠিকঠাক রাখার দায়ও আমার আছে। সব দায়, সকল দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেই এই তিনজন সন্তানকে মানুষ হবার পাঠ দিই, টিকে থাকার সক্ষমতা শেখাই। এর জন্য যে দম লাগে, যে প্রস্তুতি দরকার হয়, তা মাপার কোনো মেশিন আবিষ্কৃত হয়নি। কেউ সে দম মাপতেও আসবে না। কিন্তু আমার ভুল মাপার মানুষের অভাব কোনোদিন হয়নি, হবেও না। সে যারা মাপে মাপুক। আমার কাজ তাদের হাতে বাটখারা তুলে দেওয়া, আমি সে কাজটা হাসতে হাসতেই করি।
তরী বাইতে যখন শিখেই গেছি, শায়র আর কতো বিস্তৃত হবে? তবুও মাঝেমাঝে ক্লান্ত লাগে। মানুষ বলেই লাগে। আনন্দের বিষয় হলো, শ্রান্তিতে শুষ্রুষা দেয়ার মতো কাঁধও আমার তৈরি হয়ে গেছে। পাখির ছানাদের ডানা শক্ত হয়েছে, তারা মা পাখিকে ছায়া দিতে পারে। তাদের নিজেদেরও উড়াল দেওয়ার সময় হলো। আমারও যুদ্ধ শেষ হয়ে এলো বলে। ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে। এখন আমার হিতৈষীরা জানতে চান, এতো যুদ্ধ কেন করছি? কেন নিজের আরামটুকু বুঝে নেইনি? অধিকারটুকুও কেন ছেড়ে দিয়েছি? আমি তাদের প্রশ্ন শুনে হাসি। মনে মনে উত্তর দিই, ‘আত্মসম্মান’, ‘স্বাধীনতা’। সম্মানের চেয়ে আরাধ্য কিছু কোনোদিনও আমার ছিলো না, স্বাধীনতার চেয়ে উপভোগ্য কিছু কখনও নয়। সে যে সস্তায় মেলে না তা জানি বলেই তার মূল্য কড়ায় গন্ডায় চুকিয়েছি। সন্তানের কাছেও নিজের আরাম ভিক্ষা চাইবো না, এটুকু জানি। বহুমূল্যে এই জীবনের সার্বভৌমত্ব আমি কিনেছি। এই সার্বভৌমত্ব কিনে নেবে এমন সাধ্য কোন আমীরের আছে! ফেসবুকে ২৯-১১-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :