প্রভাষ আমিন: ১. শেষ হয়ে গেল ২০২৩ বিশ্বকাপ। ভারতের মাটিতে ভারতকে হারিয়ে রেকর্ড ষষ্ঠ শিরোপা জিতলো অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবারের বিশ্বকাপে খেলারই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। গতবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে ধুঁকতে ধুঁকতে। সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ১০ দলের মধ্যে নবম হয়েছে। সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে ভারত যাওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ কেটেছে। কোনোরকমে অষ্টম হয়ে ২০২৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। যদিও দশম হয়েছে, তবুও নেদারল্যান্ডসের পারফরম্যান্স আলো ছড়িয়েছে। এবারের বিশ্বকাপের সত্যিকারের চমক ছিল আফগানিস্তান। তারা সেমিফাইনালে যেতে পারেনি বটে, তবে গেলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
২. কাগজে-কলমে এবং মাঠের পারফরম্যান্সে এবারের বিশ্বকাপের সেরা দল নিঃসন্দেহে। গ্রুপ পর্যায়ে তাদের পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন বাস্তবের দল নয়, কম্পিউটার গেমসের মত প্রোগ্রাম করা যেন। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- সব ক্ষেত্রেই তারা দুর্দমনীয়। আগে ব্যাট করা, পরে ব্যাট করা কিছুতেই কিছু যায় আসে না। অধিনায়ক রোহিত শর্মার কাজ ছিল শুরুতেই রানের গতি বাড়িয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সেটা তিনি করেছেন ষোলোআনা। ভিরাট কোহলি তো তার জীবনের সেরা ফর্মে ছিলেন। একের পর এক রেকর্ড ভেঙ্গে-গড়ে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক কোহলি। এছাড়া ভারতের নতুন সেনসেশন গিল তো ছিলেনই, ছিলেন আইয়ার, রাহুল, যাদব, জাদেজা- ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ যেন অন্তহীন। বুমরাহ আর সিরাজ শুরুতেই প্রতিপক্ষ শিবির ত্রাস সৃষ্টি করে দিতেন। তবে ভারতের তুরুপের তাস ছিলেন মোহাম্মদ শামি। প্রথম চার ম্যাচে খেলারই সুযোগ পাননি। হার্দিক পান্ডিয়ার ইনজুরিতে পঞ্চম ম্যাচ থেকে সুযোগ পেয়েও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শামির ঝুলিতে।
৩. শুধু কাগজে-কলমে নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও ভারত সেরা। একের পর এক প্রতিপক্ষকে আউটপ্লেইড করে তাদের জয়রথ ছুটছিল দুরন্ত গতিতে। সবাই ধরে নিয়েছিল এই ভারত আনস্টপেবল। ভারতই চ্যাম্পিয়ন, শুধু খেলার অপেক্ষা। কিন্তু আমার মন বলছিল ভিন্ন কথা। ক্রিকেটে, শুধু ক্রিকেটে নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই ল অব অ্যাভারেজ বলে একটা কথা আছে। অত ভালো, ভালো নয়। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। আমার মন বলছিল, কোথাও না কোথাও তাদের পা হড়কাতে পারে। ভারতের দুর্ভাগ্য তাদের খারাপ দিনটি এসেছে ফাইনালে। ভারত ১১ ম্যাচের ১০টিই জিতেছে। হেরেছে শুধু ফাইনালে। আর প্রথম দুই ম্যাচে পরাজয় দিয়ে শুরু করা অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাড়িয়ে থেমেছে ট্রফি হাতে নিয়েই।
৪. বাংলাদেশে ক্রিকেটের জোয়ার শুরুর আগে বাংলাদেশের লোকজন ভারত-পাকিস্তান এই দুই দলকে সমর্থন করতো। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর থেকে বাইরের দেশকে সমর্থনের হার কমেছে। তবে গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে ভারতের প্রতি সমর্থন আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। জগমোহন ডালমিয়ার সৌজন্যে একটু আগেভাগে টেস্ট স্ট্যাটাস পেলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভারত বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যতটা করা দরকার ছিল, ততটা করেনি। বিশেষ করে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের বিপক্ষে চলে গেছে। এর সাথে মিশেছে রাজনীতি। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে থাকার অন্যতম শক্তি মনে করা হয় ভারতকে। তাই আওয়ামী লীগ বিরোধী অংশটি অটো ভারত বিরোধী হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ছিল। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশের মানুষ অস্ট্রেলিয়াকে পছন্দ করে। তারা আসলে যতটা না অস্ট্রেলিয়ার জয় চেয়েছে, তারচেয়ে বেশি ভারতের পরাজয় চেয়েছে।
৫. একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল। আগেই যেমন বলেছি, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রেও জগমোহন ডালমিয়ার ভূমিকা অসাধারণ। আমরাও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতের দাদাগিরি, অযাচিত হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ভারত বিরোধিতা বাড়িয়েছে। ছোট হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, ভারতকে এটা মনে রাখতে হবে। প্রতিবেশী দেশে কেন এমন উগ্র ভারত বিরোধিতা ছড়িয়ে গেল, সেটা ভারতকেই অনুসন্ধান করতে হবে এবং দূর করতে হবে।
প্রভাষ আমিন, ২০ নভেম্বর, ২০২৩
আপনার মতামত লিখুন :