মার্কিন সামরিক বাহিনী এমন এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যা বিমানের দিকনির্দেশনা বা নেভিগেশন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। প্রচলিত GPS (Global Positioning System) ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা কমাতে এবং শত্রুর দ্বারা সিগন্যাল জ্যামিং বা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে এই নতুন পদ্ধতির মূল উৎস হলো পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে থাকা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র।
মূল ধারণা: পৃথিবীর চৌম্বকীয় 'ফিঙ্গারপ্রিন্ট'
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রযুক্তির ভিত্তি হলো পৃথিবীর ভূত্বকের প্রতিটি স্থানের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের একটি নিজস্ব 'ফিঙ্গারপ্রিন্ট' বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পাহাড়, উপত্যকা বা খনিজ পদার্থের ভিন্নতার কারণে এই চৌম্বকীয় মানচিত্র স্থানভেদে বদলে যায়।
নতুন এই ব্যবস্থায়, উড়োজাহাজে অত্যন্ত সংবেদনশীল ম্যাগনেটোমিটার (magnetometer) বা চৌম্বকীয় সেন্সর লাগানো থাকবে। উড়োজাহাজটি যখন কোনো স্থানের উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তখন এই সেন্সরটি নিচের ভূত্বকের চৌম্বকীয় মানচিত্র বা সিগনেচার রেকর্ড করবে। এরপর সেই তথ্যকে আগে থেকে তৈরি করা একটি বিস্তারিত ডিজিটাল চৌম্বকীয় মানচিত্রের সাথে মেলানো হবে। এর মাধ্যমে উড়োজাহাজটি GPS সিগন্যাল ছাড়াই নিজের সঠিক অবস্থান নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারবে।
কেন এই প্রযুক্তির প্রয়োজন?
১. GPS-এর দুর্বলতা: বর্তমান বিশ্বের নেভিগেশন ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই GPS-নির্ভর। কিন্তু GPS সিগন্যালকে সহজেই জ্যাম (jam) বা স্পুফ (spoof) করা যায়। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে সিগন্যাল ব্লক করে দিতে পারে অথবা ভুল সিগন্যাল পাঠিয়ে বিমানকে বিভ্রান্ত করতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে এটি একটি মারাত্মক ঝুঁকি।
২. নির্ভরযোগ্য বিকল্প: নতুন এই চৌম্বকীয় নেভিগেশন ব্যবস্থাটি একটি 'প্যাসিভ' সিস্টেম। এটি কোনো সিগন্যাল গ্রহণ বা প্রেরণ করে না, বরং পৃথিবীর প্রাকৃতিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে। তাই একে জ্যাম করা প্রায় অসম্ভব।
৩. সর্বত্র কার্যকর: GPS সিগন্যাল অনেক সময় গভীর গিরিখাত, পানির নিচে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু চৌম্বকীয় নেভিগেশন এসব ক্ষেত্রেও কার্যকর থাকবে।
বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ
মার্কিন বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী এই প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। BAE Systems এবং Honeywell-এর মতো প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলো এই সিস্টেম তৈরির কাজ করছে।
তবে এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সমগ্র পৃথিবীর একটি অত্যন্ত বিস্তারিত ও নির্ভুল চৌম্বকীয় মানচিত্র তৈরি করা। এই মানচিত্র যত নিখুঁত হবে, নেভিগেশনও তত নির্ভুল হবে। মার্কিন সামরিক বাহিনী বছরের পর বছর ধরে এই মানচিত্র তৈরির কাজ করে চলেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই প্রযুক্তি প্রাথমিকভাবে সামরিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলেও, ভবিষ্যতে এটি বাণিজ্যিক বিমান চলাচলেও ব্যবহৃত হতে পারে। এটি GPS-এর বিকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি শক্তিশালী ব্যাকআপ বা সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে, যা বিমানের যাত্রাপথকে আরও নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করে তুলবে।
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (The Wall Street Journal)