রুমি আহমেদ: ২৫ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড লাঙ ডে। এই দিনটি বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হয় ফুসফুস স্বাস্থ্য নিয়ে এডভোকেসি ও জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য। এই বিষয়ে খুবই সংক্ষেপে কিছু কথা বলা খুব জরুরি হয়ে গিয়েছে। সিওপিডি (COPD) বা ক্রনিক হাঁপানি রোগের কথাই বলি। আমাদের দেশে প্রতি ৮ জনে একজনের সিওপিডি আছে। এর রেইটটা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বেশি। তবে সবচেয়ে অবাক করা যে ব্যাপারটা তাহলো বাংলাদেশে নারীদের ধূমপানের হার। খুব কম হলেও নারীদের মধ্যে এই রোগের হার প্রায় পুরুষদের কাছাকাছি। কিছু হাই-কোয়ালিটি রিসার্চে দেখা গিয়েছে যে বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে সিওপিডি হার শহরের চেয়ে বেশি।
এর একটা প্রমাণিত কারণ হচ্ছে আমাদের গ্রামের নারী রান্না করার সময় যে জ্বালানি ব্যবহার করেন যেমন লাকড়ি, খড়, শুকনো পাতা, গোবর জ্বালানি ইত্যাদি যাদের বলা হয় বায়োমাস ফুয়েল এগুলো ফসফুফের জন্য ক্ষতিকর। খুব হাই কোয়ালিটি রিসার্চ দিয়ে এটা প্রমাণিত যে লাকড়ি, খড়, শুকনো পাতা, গোবর জ্বালানি ইত্যাদির বদলে যারা ক্লিন ফুয়েল ইউজ করেন রান্নার জন্য (যেমন গ্যাসের চুলা) তাদের সিওপিডি রিস্ক অনেক অনেক কম। যে নারীটা সারাজীবন বদ্ধ ভেন্টিলেশনবিহীন ছোট রান্নাঘরে বায়োমাস ফুয়েল দিয়ে রান্না করে সংসারে সবার ভরণ-পোষণ করলেন, সেই নারী জীবনের শেষ অর্ধেকটা কাটলো অবর্ণনীয় শ্বাসকষ্ট নিয়ে। বিনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে।
এই যে একটা বিশাল পাবলিক হেলথ প্রবলেম। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? প্রথমত এই ব্যাপারে এওয়ার্নেস বাড়াতে হবে। পাবলিক হেলথ নেতৃবৃন্দ ও ফুসফুস চিকিৎসক/চেস্ট স্পেশিয়ালিস্টদের এগিয়ে আসতে হবে, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ওয়ার্ল্ড লাঙ ডেতে আমরা যদি কোনো অনুষ্ঠান করি, তা হতে হবে এসব লাইফ অ্যান্ড ডেথ নিয়ে কথা বলার জন্য। বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অর্থায়নে করা অনুষ্ঠানগুলো খালি ওদের ওষুধ নিয়ে কথা বলবে। এসব বায়োমাস ফুয়েল নিয়ে কথা বলে ওদের লাভ নেই। কারণ এই তিলে তিলে শ্বাস কষ্টে ভোগ বায়োমাস ফুয়েল ব্যবহারকারীদের দামি দামি ইনহেলার আর ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশ স্যানিটারি ল্যাট্রিন মুভমেন্টের সূতিকাগার। আমরা জাতীয়ভাবে সফল ব্যাপকহারে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে। আমাদের পরবর্তী জাতীয় পাবলিক হেলথ মুভমেন্ট হতে হবে ক্লিন ফুয়েল ক্লিন এয়ার আর ভেন্টিলেটেড রান্নাঘর মুভমেন্ট। আর ক্লিন এয়ার নিয়ে কথা বলা শুরু করলে তো হাজার পাতাতেও তা শেষ হবে না। আপনার ফোনে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স চেক করে দেখুন। আমাদের এয়ার কোয়ালিটি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটা রিসার্চে দেখা গিয়েছে যে যারা হিউমেন হলার, টেম্পু টাইপের যান বাহনে হেলপার হিসেবে কাজ করে তাদের মধ্যে সিওপিডি হার অনেক বেশি এবং ওদের অনেক অল্প বয়সেই সিওপিডি হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের মোটর ভেহিকল আইন আছে, ক্ষতিকর গ্যাস এমিশন স্ট্যান্ডার্ড আছে কিন্তু তার শক্ত প্রয়োগ নেই। ঢাকা শহরে বাতাসের তো আর কোনো গুলশান, বনানী ট্রাইস্টেট বাবল নাই। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ, নবজাতক, শিশু, প্রসূতি এই একই বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন। কেউ কম কেউ বেশি। এই এয়ার কোয়ালিটি ব্যাপারটা আমাদের সবার সমস্যা। অস্ট্রিচের মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে তো হবে না। এয়ার কোয়ালাটি নিয়ে কথা বলতে হবে। কাজ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানির সেমিনারগুলো এয়ার কোয়ালিটি নিয়ে কথা বলবে না। আমাদের চেষ্ট স্পেশিয়ালিস্টদের ওদের খপ্পর থেকে বের হয়ে এসে সত্যিকার এর অ্যাক্টিভিজম শুরু করতে হবে।
সিওপিডি রোগীর মূল দুটো চিকিৎসা হচ্ছে অক্সিজেন আর পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন। বাড়িতে ব্যবহার এর জন্য সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে বিনামূল্যে। স্বল্পমূল্যে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। পালমোনারি রিহাব ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে সব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। এক সিওপিডি রোগীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘মা’ আপনার কষ্টটার একটু বর্ণনা দেবেন? উনি উত্তর দিলেন, ‘পুকুর থেকে মাছ ধরে ডাঙায় তুললে মাছগুলো যেভাবে দাপায় শ্বাসকষ্টে। আমার ২৪ ঘণ্টাই ওই অনুভূতি হয়’। এদের জন্যে কিছু একটা করার প্রতিশ্রুতিই হোক ওয়ার্ল্ড লাং ডের মূল প্রতিপাদ্য। লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ