অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: সিরাজুল আলম খান রাজনীতিতে রহস্য পুরুষ হিসেবে অভিহিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো। ১৯৬২ সালে তিনি নিউক্লিয়াস নামে একটি গোপন সংগঠন করেছিলেন। এটাকে বলা হতো, ছাত্রলীগের স্বাধীনতা গ্রুপ। আমি এই গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে। নিউক্লিয়াস তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতো। তারা একটি লিফলেটও বের করতো। গোপনে। এই লিফলেট আমি বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতাম।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঢাকা বিশ্¦বিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে হঠাৎ করে নিউক্লিয়াসের একটা কর্মীসভা ডাকা হয়েছিলো। সেখানে আমি শুনেছিলামÑ সিরাজুল আলম খান বলছিলেন, শেখ মুুজিবের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ লোকে তাঁর কথা শোনে।
তার এই কথাটি আমাকে ভাবিয়েছিলো। এখনো ভাবায়। শেখ মুজিবের যে একটি সম্মোহনী শক্তি ছিলো, সেটা সিরাজুল আলম খান বুঝেছিলেন।
সিরাজুল আলম খান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নির্মাণে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু যেন ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। কারণ বঙ্গবন্ধু অনেক অভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তখন তিনি যা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার যথার্থতা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন যে দেশে একটা সর্বদলীয় জাতীয় সরকার হোক। কারণ সবার অবদানেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি প্রস্তাবও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুনেছিলেন, যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কদিন পর তিনি যখন সিরাজুল খানের সঙ্গে দেখা হয় তখন বলেছিলেন, সিরাজ, আমি পারলাম না!
সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পরবর্তী সময় যে কথা হয়েছিলো আমার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিব যদি দলের চেয়ারম্যান থেকে যেতেন, দেশ পরিচালনা বা সরকারের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতেন, তাহলে বোধহয় ভালো হতো।
এটা তার পরবর্তী জীবনের উপলব্ধি। আমরাও তাই উপলব্ধি করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুও তাই চেয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু যতোদিন দেশ চালিয়েছিলেন সাধ্যেেমতা বাংলাদেশকে সঠিক পথে নেবারই চেষ্টা করেছিলেন।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আশির দশকে অনেক বিতর্ক হয়েছিলো। তবে বাংলাদেশ নির্মাণের অন্যতম কুশীলব ছিলেন তিনি। তাঁর আমার অতল শ্রদ্ধা।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন: ইতিহাসবিদ