শামীম আহমেদ: বেশকিছু ঘটনা বেশ অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেলো। সেক্রেটারি ব্লিনকেনের ভিসা সংক্রান্ত বিবৃতির পর প্রধানমন্ত্রী প্রায় সপ্তাহখানেক পর তার বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো পৃথিবীতে আরও অনেক দেশ, মহাদেশ আছে যাবার মতো, আমেরিকায় যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী না দিয়ে সরকারের অন্য কেউ দিলে ভালো হতো কিনা সেই আলোচনা করা যায়। যেহেতু এই বক্তব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দেননি, সেই ক্ষেত্রে উত্তর দেবার দায়ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নয়। প্রধানমন্ত্রী উত্তর দেয়াতে আমেরিকার ভিসানীতি আদতে বেশ গুরুত্ব পেয়ে গেলো। সেক্রেটারি ব্লিনকেনের বক্তব্যের পর গত বেশ কিছুদিন ধরে দেশের মানুষ নানা জিনিস নিয়ে পেরেশান আছে। এর মধ্যে যে জিনিস দুটো তাদের সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে। [১] বিদ্যুৎ বিভ্রাট। [২] টিন নাম্বার থাকলেই ২০০০ টাকা কর দেবার আলোচিত বিধান।
বিদ্যুতের ভোগান্তি গতবছর শুরু হলেও তখন ইউক্রেন যুদ্ধের বিবেচনায় বিষয়টি মানুষ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছে। কিন্তু যুদ্ধের পর গত একবছরে বিষয়টির সুরাহা করার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় পেলেও কেন তা সরকার করলো না তা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করছে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, ট্রাফিক জ্যাম, দুর্নীতি, অন্যায় অবিচার ইত্যাদিতে ভারাক্রান্ত মানুষ এই ভয়াবহ তাপদাহে বিদ্যুৎ বিভ্রাট সংক্রান্ত অজুহাত শুনতে অপারগ। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমরা শাদা চোখে বলতে পারি বৈদেশিক মুদ্রার যে চাহিদার তুলনায় জোগান কম সেটির একটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জ্বালানি কেনায় অক্ষমতা ও ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ফোনে কথা হচ্ছিলো আমার আম্মা-আব্বার সঙ্গে, দেশে। তাদের বলছিলাম যে, আজ থেকে কয়েকযুগ আগে দেশে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের মাধ্যমে ডলারের যে জোগান ছিলো তার সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের একটা সামাঞ্জস্য ছিলো। অর্থাৎ উন্নয়ন কার্যক্রম যেহেতু সীমিত ছিলো তাই আয়কৃত ডলার দিয়ে মোটামুটি অর্থনীতি চালানো যেত। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপক বেড়েছে, ফলশ্রুতিতে উন্নয়ন ব্যয়ও বেড়েছে বহুগুণ। যদিও রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের মাধ্যমে ডলার দেশে ঢুকছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটা উন্নয়ন কাজের ব্যাপক পরিধির তুলনায় অপ্রতুল। ফলশ্রুতিতে, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সরকার যদি এত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিতো, তাহলে ডলার সংকট তৈরি হতো না, এবং সরকারও মোটামুটি নির্ঝঞ্জাটে ক্ষমতায় থাকতো।
কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা ঝুঁকি নিয়ে হলেও উন্নয়ন করতে চেয়েছে, ফলশ্রুতিতে ডলার সংকটেও পড়েছে। তবে একথা আমি বলতে পারি সরকার চাইলে আরও বেশ কিছুদিন খুবই নির্মোহভাবে বিদ্যুতে রেশনিং না করেই চালাতে পারত। কিন্তু তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শ্রীলংকা কিংবা পাকিস্তানের মতো বিপর্যয়ে পড়তে হতো। সেটা অনুধাবন করে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে করে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা কমেছে। আমার ধারণা বিষয়গুলো মানুষ আরও সহজভাবে নিতো যদি দেশে দুর্নীতি এতো বেশি, এতো প্রকট না হতো। সরকারের নানা পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ কর্মচারী কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য, ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য, দেশে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশ পাড়ি দেওয়া, এসব ঘটনায় মানুষ সরকারের উপর আস্থা হারাচ্ছে। খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। দেশের ফুটবলের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু বাফুফের সভাপতি হিসেবে এককালের নামকরা ফুটবলার সালাহউদ্দিন যুগের পর যুগ যেন তার পদ আঁকড়ে আছেন। শত ব্যর্থতার পরেও তাকে পদ ছাড়তে হচ্ছে না। সরকারের আমলা-মন্ত্রীরা সংকট মোকাবেলায় কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না, তবুও পদ আঁকড়ে রাখছেন কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই। মন্ত্রীপরিষদে বহুকাল কোনো পরিবর্তন নেই। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে, বাজেট ঘাটতি দেখা দিলেই নতুন নতুন করের ক্ষেত্র উন্মোচন মানুষকে এই ইঙ্গিত দেয় যে, দুর্নীতি, অন্যায়ের ফলশ্রুতিতে যেকোনো দায়ের ভার বহন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। আওয়ামী লীগ যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতের চাইতে ভালো সেটি আমরা জানি, কিন্তু দেশের অর্ধেক ভোটার যাদের বয়স ১৮, যারা জন্মের পর থেকে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেনি, তাদের কাছে এই সব ব্যাখ্যা ধোপে টিকবে না। লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ