কাজী এম মুর্শেদ: বাজেটের পর থেকে প্রশ্ন শুনছি, সর্বজনীন পেনশন স্কীম কী? উত্তরে বললাম, আমার যা আওতায় না, তার ব্যাপারে কথা বলার কী আছে। কয়েকবার প্রশ্ন শুনে মনে হলো, দুই চার লাইন লিখি। যেজন্য আমার আওতায় না তার কারণ, এটা প্রযোজ্য ১৮ থেকে ৫০ বছরের ব্যক্তিদের জন্য, যারা প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে জমা দেবে, বয়স ৬০ হবার পর মাসিক পেনশন পাবেন। আমি ৫০ উর্ধ্ব, তাই এই পেনশন দেবার বা পাবার আওতায় নেই।
আপনাদের আগে পাটিগণিত করে বুঝাই মোট কতো টাকার কথা বলছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এর মধ্যে ৬০ উর্ধ্ব মোট ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ যদি ৬০ এর মধ্যে হয়, ছয় ভাগের একভাগ পরবে ৫০-৬০ এই বয়স ব্রাকেটে। বাংলাদেশের মোট ভোটার বা ১৮ উর্ধ্ব ১০ কোটি ৯৩ লাখ। ধরলাম ১১ কোটি। তাহলে পাটিগণিতের হিসাব করি। মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ১৮+ উর্ধ্ব মোট ১১ কোটি বা ১৮ এর নীচে ৬ কোটি। ৬০+ মোট ১.৭ কোটি। ৫০-৬০ মোট ২.৫৫ কোটি। অর্থাৎ ১৮ থেকে ৫০ বছরের মানুষ মোট ৬ কোটি ৭৫ লাখ। প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে সর্বজনীন পেনশন ফান্ডে সরকারকে জমা দেওয়া ৬৭৫ কোটি টাকা। বছরে জমা ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
অংকে ভুল থাকলে ঠিক করায় দিয়েন। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিদেশ সফর, শিক্ষাসফর, কূটনৈতিক সফর বাবদ প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ থাকে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সেখানে পেনশন স্কীমের জন্য সারা বছরে সকল প্রাপ্ত বয়স্ক ১৮ উর্ধ্ব এবং ৫০ বছর পর্যন্ত বয়েসীদের জমা টাকা বছরে ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এতো টাকা আসবে যে রাখার জায়গা পাওয়া যাবে না। এই টাকা কী করা হবে? এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চয়পত্র কিনবে, যে সঞ্চয়পত্র আবার তারাই ইস্যু করে। সেই সঞ্চয়পত্রের সুদ দিয়ে ৬০ উর্ধ্বদের মাসিক পেনশন দেওয়া হবে।
২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৪০ হাজার কোটি টাকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালানোর জন্য মোট বিক্রি হয় ১৯ হাজার কোটি টাকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টার্গেট ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার। আপনারা কী সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঞ্চয়, যা সরকারি সঞ্চয়পত্র তার ধারা দেখছেন? গত অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিলো ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০ হাজার কোটির মতো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে, বাকিটা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কারণে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ছাপতে হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ যা ঋণ নেওয়া হয়েছিলো পুরোটাই টাকা ছেপে পুনরায় যোগান দেওয়া।
ট্রেন্ডটা কি ধরতে পারছেন? বছরে যে ৮ হাজার কোটি টাকা ৬.৭৫ কোটি জনগণ থেকে নেওয়া হবে, তার সুদ অংশ পেনশন হিসাবে দিলেও মোট আসল অংশ আবার নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়তে হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কীমের বর্তমান অবস্থা কী? জানা নেই। কোন আইন হয়েছে বা নীতিমালা করা হয়েছে? জানা নেই। একমাত্র যতটুকু জানি তাহলো: [১] ২০১৮ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো। [২] ভোটের আগে সরকার চালু করতে চায়। [৩] মোট ১৬ সদস্যের কমিটি, যার প্রধান হবেন অর্থমন্ত্রী, তারা টাকা ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার নির্ধারণ করবে। [৪] এই ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সীমিত আকারে পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে শুরু করার পরিকল্পনা আছে। [৫] যেহেতু বছরের শেষে নির্বাচন, কমিটি এখনই কাজ করতে চায় না, কারণ পরবর্তী সরকারে কমিটি নাও থাকতে পারে। শুরু করে এরপর ঝামেলায় পড়তে চায় না।
[৬] একমাত্র সমাধান হলো, নির্বাচনে ইশতেহার পূরণ করতে সামান্য কিছু ব্যক্তি নিয়ে শুরু করে দেখানো যে জনগণ নিজ থেকে এগিয়ে আসছে। উন্নত দেশে, বিশেষ করে আমেরিকায় ৪০১ বা ফোর ও ওয়ান স্কীম অনেকটা এমন। তবে সেটা বাধ্যতামূলক না। যার ইচ্ছা টাকা জমা দেয়, রিটায়ারমেন্টের সময় চার লাখ ১ হাজার ডলার হাতে পায়। এই ৪০১ থাকলে সেটা দেখিয়ে ব্যাংকলোন নেওয়া যায়, সন্তানদের স্টুডেন্ট লোন নেয়, এবং টাকা পুরোটাই আয়কর মুক্ত। আমাদের সরকারের মতিগতি সবসময় ধরতে পারি না, চেক ভাঙালে ১০ টাকা ভ্যাট নেয়, সেখানে এই পেনশন স্কীমের জমা টাকার উপর ট্যাক্স, ভ্যাট ও সারচার্জ বসিয়ে কতো টাকা যাবে, এখনও নিশ্চিত না। আগে সর্বজনীন পেনশন স্কীমের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড়াক, পরে দেখা যাবে আপনারা কেউ পাইলট প্রজেক্টে আসেন কি না। লেখক: অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক