অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান: জ্বালানি সংকট হচ্ছে একটি পুরনো সংকট, যা এখনও চলমান আছে। যখনই জ¦ালানির দাম বেড়ে গেলো, তখন এটা ক্রয়ের জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার দরকার ছিলো, তখনই সেটার সংকট দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে। এখানে দুইটা ব্যাপার, একটা হচ্ছে বিদ্যুতের উৎপাদন আর একটা হচ্ছে জ¦ালানি যোগাড় করা, বিদ্যুতের উৎপাদনে যে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, জ্বালানির ব্যাপারে সেই পরিমাণে মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
আমরা গ্যাস উত্তোলনে চেষ্টা শুরু করেছি, কিন্তু এটা অনেক বিলম্বিত হয়ে গেছে। এটা আরও অনেক আগে চেষ্টা শুরু করলে ভালো হতো। আমাদের নিজস্ব গ্যাস থাকলে এই সমস্যাটা শুরু হতো না। একদিকে ডলারের সংকট যেমন আছে, অন্যদিকে যাদের সঙ্গে কয়লার চুক্তি ছিলো, তাদের সঙ্গে পেমেন্টে বিলম্ব হয়েছে, এখন পেমেন্ট করা হয়েছে। কিন্তু এখন পেমেন্ট করলে তো সঙ্গে সঙ্গে কয়লা আসে না, এটা আসতে আরও ২০দিন ২৫দিন লাগবে, এখন মনে হচ্ছে ২ সপ্তাহ লাগবে।
বিদ্যুৎ এমন একটা জিনিস যার সঙ্গে পুরো অর্থনীতির চাকাটা জড়িত। যেকোনো মূল্যে অন্যান্য খাতে আমাদের আরও কমিয়ে বা আমদানির ক্ষেত্রে যদি রেস্ট্রিকশন আরোপ করতে হয়, আমাদের বিলাস-সামগ্রী যেমন আপেল এখনও আসতেছে বাজারে কমলা আসছে, এই যে এখন হচ্ছে ফলের সিজন দেশি ফলের ছড়াছড়ি সেখানে বিদেশ থেকে মাল্টা, আপেল আনতে হবে কেন। এরকম বিলাস সামগ্রী সব টোটালি স্টপ রেখে সেখান থেকে টাকা সাশ্রয় করে তা দিয়ে আমাদের জ্বালানি যোগাড় করতে হবে এবং জ্বালানির জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
বিদ্যুতের কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ তৎপরতা দেখা যায়, এবারও দেখা যাচ্ছে বাজেট রাখা হয়েছে, ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। জ্বালানি গ্যাসে, কয়লা উৎপাদনে আহরনে এবং সংগ্রহে এদিকে তেমন গুরুত্ব পায়নি, এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভোলায় আমাদের নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো কীভাবে মেইন লাইন এ আনা যায়, সেটার অর্থসংস্থানের জন্য পাইপ লাইন হবে কি না, ভোলাতে যদি আমরা একটা ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপন করে ফেলতে পারি, তাহলে সেখানে সার উৎপাদন করা যাবে সেখানের গ্যাস দিয়ে। আর দরকার হলে আমাদের এদিকে পুরনো যে সার কারখানাগুলো আছে এগুলো দু’চারটা বন্ধ করে দিলে আমাদের সার কারখানা যে গ্যাসগুলো আছে সেগুলো আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারবো।
এখন যেভাবে সিলিন্ডার এ ভরে ভরে গ্যাস আনা হচ্ছে এগুলো বেশ ব্যয়বহুল। এখন সারকারখানাগুলো ভোলাতে নিয়ে যেতে পারলে অনেকটা গ্যাস সাশ্রয় হবে। এরকম পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এখন প্রবলেম হচ্ছে অসহনীয় গরম, তাপমাত্রা ওঠে গেছে ৪২ ডিগ্রির মতো কিন্তু রিয়েল ফিলিং মনে হচ্ছে ৪৮ এর মতো, মনে হচ্ছে সৌদি আরবের মতো আবহাওয়া যার কারণে স্বাভাবিক ভাবে মানুষ চরম অস্বস্তিতে আছে বিদ্যুতের কারণে। গত একশ বছরেও মনে হয় আমাদের দেশে এরকম গরম অনুভূত হয়নি। উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা-দীক্ষা লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বিদ্যুৎখাতকে, সেখানে যদি অনেক খরচও করতে হয় জ্বালানি তেল কিনেও করতে হয় তা হলেও এই সমস্যার সমাধান করা উচিত।
আমাদের বাপেক্স এর সাগর থেকে গ্যাস উৎপাদন করার সক্ষমতা নেই যার কারণে বিদেশিদের ইনভাইট করা হয়েছিলো, কিন্তু তারা এসে যে দামে আমাদের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে চেয়েছে, তখন দেখা গেছে বাজারে এরচেয়ে কমদামে এলএনজি গ্যাস পাওয়া যায়, সরকারের জন্য এটা একটা সংকট। তখন এই বিডিংটা হয়নি, এখন যখন আবার গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে তখন আবার নতুন করে সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে আবার বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে, দেখা গেছে যদি লংটার্ম চুক্তি করি যদি দাম কম থাকে তখন সবাই এটার পক্ষে কথা বলে আবার দেখা গেছে বাজারে যখন এর চেয়ে কমদামে বাজারে এলএনজি পাওয়া যায় তখন আবার বলে সরকার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি না করলে এত টাকা লস হতো না।
যে একটা ম্যাট্রিক্স তৈরি করা দরকার যে একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি করা দরকার এই জ্বালানি সংক্রান্ত সেইটা আমাদের অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে করতে হবে এবং যত দ্রুত করবে ততো এই সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের জ্বালানি অথবা বিদ্যুতের সংকট নেই, সংকট হচ্ছে একটাই আমাদের ডলার সংকট, কয়লা আমরা নিয়ে আসতে পারি, আমাদের কয়লার অবকাঠামো যেগুলো তৈরি হয়েছে পায়রা, রামপাল, মাতারবারি এগুলো চালিয়ে রাখতে পারলে এগুলো থেকে আমাদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ হবে আমাদের আরও পাওয়ারপ্ল্যান্ট তৈরি হবে এক বছরের মধ্যে তাহলে আমাদের এই সংকট থাকবে না, আমাদের সংকট হচ্ছে ডলারের সংকট।
এটা আমাদের সংস্থান করতে হবে আর বাকি অবকাঠামো যেটা আছে অনেক এগিয়ে গেছে, ডলার হলেই আমরা জ্বালানি কিনতে পারবো, জ্বালানি কিনলে আমরা ২০ হাজার মেগাওয়াট এর মতো উৎপাদন করতে পারবো। অতএব এটা নিয়ে আমাদের সমস্যা না, আর যদি গরম একটু কমে তাহলে আমাদের যে দ্বিতীয় হাজার আড়াই হাজারের মতো ঘাটতি আছে, এটা কমে ১ হাজার দেড় হাজার এ চলে আসবে। বৃষ্টি হলেই এটা অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে।
আবার কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো কয়লা চলে আসবে এবং আসাটা যদি দু’তিন মাস কন্টিনিউ করে এরপর আসবে বর্ষাকাল, তখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে তারপর আমাদের যে ডলারের সংকট আছে, সেটাও কাটিয়ে উঠা যাবে আমার ধারণা এ বছরের শেষের দিকে অথবা আগস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে বিদ্যুতের সংকট কাটিয়ে উঠা যাবে। সরকারের এই সংকট কাটিয়ে ওঠা অবশ্যই জরুরি। কারণ সামনে নির্বাচন, এখন ডলারের সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পারলে অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে কিন্তু জ্বালানি নেই, এজন্য এই সংকটটা কাটিয়ে উঠাতে হবে। আইএমএফ আমাদের কোনো শর্ত দেয়নি আমরাই দিয়েছি, ওদের শর্ত ছিলো কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না, সরকার সেই ভর্তুকি একেবারে প্রত্যাহার করেনি বরং আরও বাড়িয়েছে, তাই আইএমএফের শর্তের সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
পরিচিতি: সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শ্রুতিলিখন : মিরাজুল মারুফ