খালেকুজ্জামান: আমাদের বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি আমলাতান্ত্রিক। এই বাজেট উপর থেকে তৈরি করে দেওয়া হয়। গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে কেন্দ্র এভাবে সর্বস্তরের জনগণের মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্ব দেওয়া হয় কি? যেহেতু স্থানীয় সরকার বলে কিছু নেই, সবই হচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসনের কতোগুলো বিস্তৃত বাহু। ফলে প্রকৃত অর্থে জনগণের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা গড়ে ওঠেনি। না ওঠার কারণে জনগণের মতামত গ্রহণ করার কোনো প্রক্রিয়াও সেখানে নেই। ফলে যেভাবে এখানে বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে, জনগণের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তাদের মতামত থাকছে না।
বাজেট কি জনস্বার্থে ব্যবহার করা হবে, নাকি লুটপাটকারী দেশি-বিদেশি ধনীক শ্রেণির সুবিধাই কি প্রাধান্য পাবে? পেতে থাকবে? এসব নিয়ে আলোচনা থাকে না। বাজেট নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আলোচনা থাকলে, কারণ টাকা তো জনগণ দেবে। বিদেশ থেকে ঋণ করুক, দেশ থেকে দিকÑসবটাই তো জনগণের টাকা। ফলে জনগণের টাকা কোথায় খরচ হবে, কী প্রয়োজনে খরচ হবে, কারা খরচ করবে সে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা থাকে।
বাজেটটা আমলাতিন্ত্রকভাবে তৈরি হবে। বাজেটের খরচও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে খরচ হবে না। জনগণের মতামতও সেখানে থাকবে না। বাজেটের টাকা বরাদ্দ হবে, তারপর কার্যকর হবে। কিন্তু কীভাবে এই টাকা কার্যকর হবে, কোথায় কার্যকর হবে, কাদের মাধ্যমে হবে, জবাবদিহিতা কী থাকবে, এ নিয়েও কোনো আলোচনা নেই। তাই আমরা বলছি, বাজেট নীচ থেকে ওঠে আসা উচিত, ওপর থেকে চাপানো নয়। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা বা বিভাগ থেকে প্রস্তাবগুলো এলে তা কাটছাট হতে পারে, সংসদ সদস্যরা সারাদেশের মানুষের এসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবেন। জাতীয় স্বার্থ ও স্থানীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বাজেট কাটছাট করে চূড়ান্ত করবেন। এটা আমলাদের কাজ নয়। এই কাজ আইনসভার সদস্যরা যারা আছেন, পার্লামেন্ট মেম্বার যারা আছেন, নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদের কাজ। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করবেন। তারপর চূড়ান্ত করবেন। জনগণের মতামত চূড়ান্ত করার সময় আমলারা কিছু কিছু সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেটা পরিসংখ্যানের কাজ হোক, বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা তারা দিতে পারেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের যে দায়িত্ব সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন হয় না।
এখানে তাহলে কী হয়? কারা বাজেট তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে? আমলারা ঠিক করে দিলো। ব্যবসায়ীসহ এখানকার বিত্তবানদের সঙ্গেই কথাবার্তা হয় বাজেট নিয়ে। কিন্তু বাস্তবে এখানে শ্রমিক বা কৃষক প্রতিনিধি অথবা অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে যে আলোচনা হওয়া দরকার, তা হয় না। শিক্ষক, অভিভাবকদের দাবি কী। স্বাস্থ্যসেবার হাল কী। সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করা দরকার। এর ভিত্তিতেই বাজেট প্রণয়ন ও পাস হওয়া বাঞ্ছনীয়। যা গণতান্ত্রিক।
বাজেট গণতান্ত্রিকভাবে হচ্ছে না। বাজেট হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকভাবে প্রণিত হচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নও জবাবদিহিতামূলক হয় না। লোক দেখা উন্নয়ন দরকার, নাকি বাস্তবে সাধারণ জনগণের উন্নয়নের জন্য জীবনমানের উন্নতি দরকার। জনগণের স্বার্থ কোথায় বেশি আছে, জনগণের স্বার্থের ব্যাপারটি হয়তো দৃশ্যমানতায় আনা যাবে না, ইট, কাঠ, পাথর দিয়ে বড় দৃশ্যমান জিনিস তৈরি করে উন্নয়নের চেহারা দেখানোর চেয়েও সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা, তাদের শিক্ষা, তাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন কতোটা গুরুত্ব পাবে, এ বিষয়গুলো বাজেট ও আলোচনায় আসে না।
প্রতিবছরই আমাদের দেশে গতানুগতিক যে বাজেট হয়, তা আমলান্ত্রিকভাবে প্রণীত হয়। আমলারা পুরনো বাজেট যোগ-বিয়োগ বা কিছুটা এদিক-ওদিক করে কিছু পরিসংখ্যান তারতম্য করে বাজেট হাজির করে। আর পার্লামেন্টে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করে পরে হাত তুলে সমর্থন দিয়ে পাস করিয়ে দেয়।
বাজেট পাসের পর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, টাকা বরাদ্দ করা হয়। যেমন কোনো একটা জেলা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়নের মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে আপনাদের এলাকায় যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, আপনারা কতো টাকা পাবেন জানেন কি? কোথায় টাকাটা বিলি হবে? কোথায় কাজে লাগানো হবেÑ কেউ বলতে পারবে না। ফলে কার প্রয়োজনে কীভাবে বাজেট হচ্ছে, এটা জনগণ জানে না। ফলে এই পরিস্থিতির মধ্যদিয়েই চলছে।
প্রতিবছর বাজেট আসে, কিন্তু দেখা যায় জনসাধারণের জীবনমান নামে। আর মুষ্টিমেয় কিছু লোকের উন্নতি ঘটে। দিনে দিনে গোটা জাতিকে ঋণগ্রস্ত করা হয়। সেই ঋণের বোঝা মানুষের মাথায় থাকে। বাজেটের সুফল মানুষের কাছে সেভাবে পৌঁছায় না। এভাবেই গতানুগতি ধারায় বাজে চলে আসছে। এই ধারাকে গণতান্ত্রিক বলা চলে না। একটা গণতান্ত্রিক শাসন যেহেতু নেই, বাজেট প্রক্রিয়াটাও গণতান্ত্রিক নেই। এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য বাজেট প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিক করার জন্য একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা যদি সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠাত করা যায়Ñতাহলে বাজেটকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করা, সেটাকে বাস্তবায়ন করা এবং জবাবদিহিততামূলক করা সম্ভব। পরিচিতি : কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা, বাসদ