মোকাররম হোসাইন: রাসুল (সা.) এর সঙ্গে বিয়ের সময় আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর বয়স নিয়ে একটা মিথ আছে। প্রচলিত মতানুযায়ী আয়েশার বিবাহের বয়স ৬ বলা হয়। বলা হয় না ৬ হলো বিবাহের চুক্তি বা আক্তের সময়কালে বয়স। বিবাহ কার্যকর হয় ৩ বছর পর অর্থাৎ ৯ বছর বয়সে। প্রচলিত মতকে সত্য ধরে নিলেও বিবাহের বয়স ৯। চুক্তির বয়সকে বিবাহের বয়স বলে চালিয়ে দেওয়া সত্য গোপন হয়। প্রচলিত এই বর্ণনার অন্যতম উৎস ইবনে হিশাম। আরও কিছু বর্ণনা থাকলেও হিশামের বর্ণনাকে সবচেয়ে সহী বাবা হয়। ইবনে হিশামের জীবনিকারদের মতে, হিশামের বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিবিভ্রাট সমস্যা ছিলো। এই বয়সে যেকোনো মানুষের সেটা হয়ই। হিশাম সত্তর বছর বয়সে ইরাকে হিজরত করেন। ইরাকে থাকাকালে হিশাম বর্ণিত হাদিস সমূহ সম্পর্কে একটা সতর্কতা জারি রাখতেন হাদিসবিশারদরা। আরও কিছু বর্ণনাতে বিবাহকালে আয়েশার বয়স কম থাকা নিশ্চিত হলেও, সেই বয়সটা কি ৬ বছর?
আয়েশার শৈশব ও বিবাহিত জীবন নিয়ে আরও বহু হাদিস আছে। ইবনে হিশাম বর্ণিত হাদিসের সঙ্গে আয়েশা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হাদিসে পাওয়া তথ্য ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের জীবনীকারদের বিভিন্ন বর্ণনাকে আমলে নিতে হবে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে এত এত স্পষ্ট তথ্য আছে যার আলোকে নিশ্চিত বলা যায় না যে ইবনে হিশামের বর্ণনা ত্রুটিহীন ছিলো। এত সব তথ্য বাদ দিয়ে কেবল ইবনে হিশাম বর্ণিত হাদিসের উপর ভিত্তি করে নবী মুহাম্মদের নামে অপপ্রচার চালিয়েছে ইসলামোপোবিকরা।
এমনকি হিশামের বর্ণনা মতেও বিয়ে ৬ বছর বয়সে হয়েছে বলা সত্য গোপন করা হয়। হিশামের বর্ণনাতে ৬ বছর বয়সে মূলত বিবাহেরর চুক্তি হয়েছে। বিবাহ কার্যকর হয় ৩ বছর পর অর্থাৎ আয়েশা ৩ বছর পর ৯ বছর বয়সে মুহাম্মদ (স.) এর গৃহে বধূ হিসেবে আসেন। কোন বয়সে বিবাহের চুক্তি হয়েছে সেটা বিবাহের বয়স হবে না, বরং চুক্তি কার্যকর হওয়ার বয়সকে বিবাহের বয়স ধরতে হবে। কাজেই হিশামের বর্ণনাকে সঠিক ধরলেও বলতে হবে ৯ বছর বয়সে আয়েশার বিবাহ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন আয়েশাকে ৩ বছর অপেক্ষা করতে হলো? এই প্রশ্নের সুরাহা হলে আয়েশার বিবাহের সঠিক বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
আরবের গোত্রবাদি ঐতিহ্য অনুযায়ী মেয়েদের পিরিয়ড না হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েদের বিবাহ দেয়া হতো না। পিরিয়ড হওয়া একটা মেয়ের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠা বিবেচিত হতো। এই চর্চাটা দুনিয়ার অন্য সব সমাজে মোটামুটি হাজির ছিলো। বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যে পিরিয়ড হওয়ার আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিলো। ১৩ বছরের আগে মেয়েদের বিবাহ আইনত অপরাধ বিবেচিত হতো। পারস্যের সাসানিয় সাম্রাজ্যে ১২ বছরের আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিলো। ভারত উপমহাদেশে বাল্যবিবাহ প্রচলন থাকলেও পিরিয়ড হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েরা স্বামীর ঘরে থাকতেন না। পরিবারের অন্য মহিলা আত্মীয়ের সঙ্গে থাকতেন। স্বামীর ঘরে থাকার অনুমতির আগ পর্যন্ত দুজনের দেখা-সাক্ষাৎও নিষিদ্ধ ছিলো। কোরআনে সূরা তালাকেও পিরিয়ড হওয়ার আগে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো আয়েশার ৯ বছর বয়সে পিরিয়ড হয়েছিলো কিনা? আরবের মেয়েদের পিরিয়ড বয়স ১৫ এর আগে-পরে ঘটে। ৯ বছর বয়সে পিরিয়ড স্বাভাবিক ঘটনা না। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আয়েশার বিবাহ কার্যকর হয়েছিলো পিরিয়ড হওয়ার পর। এখন আয়েশার শৈশব ও বিবাহিত জীবনের শুরুর দিককার বর্ণনাগুলো আমলে নিলে এটা নিশ্চিত বলা যায়, অল্প বয়সেই আয়েশার বিবাহ হয়েছিলো। কিন্তু সেই বয়সটা কত? আয়েশার পিরিয়ড ১২-১৫ এই বয়সের মধ্যেই হবে। হতে পারে স্মৃতিবিভ্রাটের কারণে হিশাম ৯ বছর বয়সে বিবাহ হওয়াটাকে বিবাহ কার্যকর হওয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। যদি বিবাহ ৯ বছর বয়সে হয়, তো কার্যকর হয়েছে ১২ বছর বয়সে। অর্থাৎ আয়েশার বিবাহ বয়স ১২। সেটা সর্বোচ্চ ১৫ হতে পারে। যদিও আরও নানান বর্ণনা সূত্র থেকে অনেকে আয়েশার বিবাহ কার্যকর হওয়ার বয়স ১৫, ১৭, ১৯ এমন দাবিও করেন। তাতে বিবাহ চুক্তির পর ৩ বছর অপেক্ষা যুক্তিযুক্ত হয় না। অতটা বয়সে পিরিয়ড হওয়াও স্বাভাবিক ঘটনা না। তবে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতেই পারে। আমরা আপাতত ব্যতিক্রমতা আমলে নিচ্ছি না।
আরেকটা বিষয় বলে রাখি। খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর পর রাসূল (স.) এর পরিবারের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জরুরত ছিলো যিনি পরিবারের দায়িত্ব নিবে। সেই সময়েই সাওদা (রা.) ও আয়েশা (রা.) দুজনের প্রস্তাব আসে। সাওদা রা. ছিলেন ৫০ ঊর্ধ্ব বিধবা মহিলা। অন্যদিকে ৬ বছর বয়সী এক শিশুর প্রস্তাব আসাটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। এ কারণেও অনেক ঐতিহাসিক হিশাম বর্ণিত আয়েশার বিবাহ বয়স নিয়ে আপত্তি তুলেন। ফেসবুক থেকে