আহসান হাবিব: [১] কতো নিদ্রাহীন রাতের শেষে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কতো অশ্রু, কতো অপেক্ষার শেষে একজন আর একজনকে বলে উঠে ‘ভালোবাসি’। কিন্তু কী আশ্চর্য, কটা দিন যেতেই তৃতীয় একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটে। হয়তো ছেলেটির জীবনে কিংবা মেয়েটির। কিন্তু কখনোই একসঙ্গে দু’জনের জীবনে ঘটে না। যদি ঘটে, ঘটে কদাচিৎ। আবার তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ঘটে না এমন সম্পর্ক প্রায় বিরল। কেন এমন হয়? কেন এমন কাক্সিক্ষত বহু সাধনায় পাওয়া একটি সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়? এটা কি মানব নামক প্রজাতির একটি বেসিক ইনস্টিঙ্কট? যদি এমন ঘটনা বিরল হতো, তাহলে হয়তো এমন বলা যেতো না, কিন্তু ঘটনাটি বিরল নয়, সাধারণ। তাহলে এটা কি জৈব বৈশিষ্ট্য মানে জেনেটিক? জানি না।
হয়তো সামাজিক বিবর্তনের ধারায় এমন একটি বৈশিষ্ট্য মানবপ্রজাতি তার জিনোমে যুক্ত করে ফেলেছে। আমরা জানি প্রাণী সেটাই তার জিনোমে যুক্ত যা তার অস্তিত্বের প্রশ্নে সহায়ক হয়। তাহলে কি একটি সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সম্পর্ককে শক্তিশালী করে? করে আবার করে না। মানুষ যখন একজনকে নিজের জন্য পেয়ে যায়, তখনই শুরু তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এই ভয় উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। তবে তার জন্য বেশি প্রযোজ্য যে পাওয়ার জন্য বেশি সক্রিয় ছিলো। যেকোনো সম্পর্কেই দেখা দু’জনের ভালোবাসার মধ্য একটু হলেও কমবেশি আছে। যে প্রথম ‘ভালোবাসি’ বলে সে চিরদিন কম ভালোবাসা পেতে থাকে। এটা তাকে নিরাপত্তার অনুভব দিতে থাকে। ফলে এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে মুক্তির জন্য ভালোবাসার পাশাপাশি আর একজনের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে থাকে। এটা হয়তো সচেতন কোনো প্রক্রিয়া নয়, অবচেতন। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি দেখা দিলেও কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না বিশেষ করে যার জীবনে ঘটে। বরং সে হয়তো আরও ভালোবাসা প্রকাশ করে। এই অতিরিক্ততা হয়তো তার সম্পর্ককে লুকাবার জন্য। শুরু হয় লুকোচুরি খেলা।
এই লুকোচুরি চলে উভয়দিকে। দুইদিকেই মিথ্যাচার করতে হয়। এখানেও ভালোবাসার কমবেশি থাকে। সম্পর্কটি পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। কিন্তু এক সময় এটির শেষ হয়। তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পর্কটি ভেঙে যায়। দুজন মানুষ সম্পর্ক হারিয়ে মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে শুরু করে। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কি তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে? এরকম কদাচিৎ হয়। তাহলে এই তৃতীয় ব্যক্তির কি ভূমিকা?
ভূমিকা খুবই প্রগতিশীল। এই তৃতীয় ব্যক্তিই সম্পর্ককে গতিশীল রাখে এবং মৃত্যুর দিকে যাত্রা করায়। কারণ যার-এখানে সম্পর্ক-জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে। তাহলে প্রেম নিয়ে মানুষ এতো সরব কেন? কেন মানুষ প্রেমের জন্য পাগল হয়ে উঠে? কেন একজন আর একজনকে যতক্ষণ না পায় পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।
সামান্য ক্ষণের জন্যই এই উচাটন। এই সামান্যের জন্যই প্রেম এতো মহান, এতো কাঙ্খিত। প্রেম যদি দীর্ঘস্থায়ী হতো, কোনো আনন্দ থাকতো না, অন্য আর পাঁচটা ঘটনার মতই প্রাত্যহিক হয়ে যেতো। প্রেমে একজনকে না পেলে কিংবা উভয়কে উভয়ে না পেলে অনেকে আত্মহনের পথ বেছে নেয়। এটা ঘটে না পাওয়ার যাতনা থেকে। পাওয়ার পর এমন ঘটনা প্রায় বিরল। এই যে সম্পর্ক তৃতীয় ব্যক্তির অনিবার্য উপস্থিতি এটা কি খারাপ কিছু?
মনে হয় না। বরং ভালো। যদি তা নাই-ই হতো, তাহলে মানবজীবনে তা ঘটে কেন? এর ভালো দিক হলো যখন একটা সম্পর্ক এমন সংশয় দেখা দেয়, তখন ভালোবাসা দৃঢ় হতে থাকে। কিন্তু কূটাভাস হচ্ছে যত দৃঢ়তা ততো ফসকে যাওয়ার দিকে যাত্রা। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি যেন প্রগতির চাকা। অর্থনীতিতে যেমন যে কোনো উন্নতিতে একটি অনিবার্য কালো হাত যে হাত লুটে নেয় অর্থ কিন্তু হয়ে পড়ে একটি মেট্রোরেল কিংবা পদ্মাসেতু। তাহলে কি তৃতীয় ব্যক্তি কিংবা কালো হাতের উপস্থিতি মেনে নেয়া উচিত?
একদম নয়। কোনকিছুই মেনে নেয়া যাবে না। মেনে নিলেই সবকিছু থেমে যাবে। একদিকে চলবে সম্পর্ক অন্যদিকে চলবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রেমের জন্য রাগ অভিমান অভিযোগ আর উন্নয়নের জন্য চলবে মিছিল মিটিং ঘেরাও গণআন্দোলন। [২] প্রেমে কিংবা উন্নয়নে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির জয় হোক। ভেঙে আবার নির্মিত হোক সৌধ, সরু পথ হোক বিস্তৃত, সমতল থেকে রাজপথ উঠে যাক শূন্যে। দেশে দেশে গড়ে উঠুক বেগমপাড়া, সুইসব্যাংক, মাফিয়াতন্ত্র। গড়ে উঠুক তাজমহল, নির্মিত হোক আনারকলি, দেবদাস, লাইলী মজনু, ডায়নার মৃত্যু। লেখক: ঔপন্যাসিক