শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ০৩:২৪ রাত
আপডেট : ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ০৩:২৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলা ওয়েব সিরিজের সম্ভাবনা ও দুর্বলতা

শামীম আহমেদ

শামীম আহমেদ: বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ দেখেছি, কিন্তু কেমন লেগেছে জানানো হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের আলাপচারিতা পড়েই এগুলো দেখা। আমার প্রতিক্রিয়া সাধারণ দর্শকের প্রতিক্রিয়া কারণ আমি বোদ্ধা নই। আমার কাছে মনে হয়েছে নব্বই দশকের শেষের দিকে স্যাটেলাইট চ্যানেল আসার পর বাংলা নাটকের যে ধারাবাহিক অধঃপতন এবং যাদের হাতে এই অধঃপতন, উভয় পক্ষকে সরিয়ে দিয়ে নতুন বেশ কিছু ভাল পরিচালক ও অভিনেতা আস্তে আস্তে আবার ফিরে আসতে শুরু করেছেন। এদের অনেকে আগে টিভি চ্যানেলে কাজ করে ভালো কিছু করতে না পারলেও ওয়েব সিরিজে দুর্দান্ত কাজ করছেন। যার ফলে বোঝা যাচ্ছে সৃজনশীল কাজের জন্য কাজ প্রকাশের মাধ্যম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। টিভি চ্যানেলগুলো মোটামুটি ফ্রিতে দেখালেও আমরা আর তাদের নাটক দেখি না নিম্নমানের কারণে। অথচ ওটিটিতে মাসে মাসে টাকা দিয়ে এইসব সিরিজ আমরা আগ্রহ নিয়ে দেখছি। আমরা যে টাকা দিচ্ছি তার বিনিময়ে পরিচালক, স্ক্রিপ্টরাইটার, অভিনেতারা ভালো কাজ করছেন। আবার তাদের অনেকে সমপরিমাণ টাকা বিজ্ঞাপন থেকে পেলেও প্রাইভেট চ্যানেলে ভালো কাজ করতে পারছেন না। সুতরাং যেসব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেন, তাদের বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্ট বিভাগে শিল্প-সাহিত্য বোঝেন এমন মানুষকে কাজে লাগানোর সময় এসেছে। বাংলা ওটিটি নিয়ে আমার একটা বড় আপত্তি হচ্ছে, নেটফ্লিক্স বা এমাজন প্রাইম যেমন আমরা টিভি খুলে সাবস্ক্রাইব করলেই টিভিতে দেখতে পারি, বাংলা ওটিটি সেভাবে সরাসরি দেখা যায় না, আলাদা ডিভাইস লাগিয়ে, বা এক্সটেন্সান লাগিয়ে বা মোবাইল বা ল্যাপ্টপ থেকে ট্রান্সফার করে দেখতে হয় যেটা খুব বিরক্তিকর। যাই হোক আমার দেখা আলোচনাযোগ্য ৫টি সিরিজ নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া সংক্ষেপে জানাচ্ছি। ও আচ্ছা আরেকটা জিনিস, রেটিংয়ের সব জিনিস গড় করে ওভারঅল রেটিং করতে যাবেন না, আমি গণিতজ্ঞ নই। এটা হচ্ছে আমার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। 

[১] কাইজার : আফরান নিশো আমার প্রিয় অভিনেতা। অথচ প্রথম দিকে যখন তার অভিনয় দেখেছি তখন মনে হতো ভাঁড়ামো। ভালো কাহিনি আর পরিচালক আর সাথে নিজের ভালো কাজ করার ইচ্ছা থাকলে কী করা যায় সেটা আফরান নিশো করে দেখিয়েছেন গত কয়েকবছরে। কাইজারে তিনি খুব ভালো অভিনয় করেছেন। জমজমাট কাহিনির চমৎকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচালক তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ওয়েবসিরিজটির মন্দ দিক তেমন কিছু দেখিনি। ভালো কাহিনি, পরিচালনায় মুন্সিয়ানা আর প্রত্যেক কলা-কুশলীর দুর্দান্ত অভিনয় এটিকে হৈচৈ-এ দেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় ওয়েব সিরিজ বানিয়েছে। একসাথে এতোজন ভালো অভিনেতাকে এক জায়গায় করা কিংবা এতোজন শিল্পীকে দিয়ে ভালো অভিনয় করিয়ে নেওয়া, যেকোনো ক্ষেত্রে পরিচালকের দক্ষতার নিদর্শন। বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং পরিচালকসহ পর্দার পেছনের প্রায় কাউকে চিনি না, কিন্তু প্রত্যেকের কাজ মুগ্ধ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সংলাপ আছে, যেগুলো কেটে ছেটে ৩০ মিনিটের ৮টি পর্বে কাইজারের প্রথম সিজন শেষ করে দিলে এর মাঝে আর খুঁত ধরবার মতো তেমন কিছু থাকত না। ওভারঅল রেটিং : ৯.৫। অভিনয় : ১০। পরিচালনা: ৯.৫। কাহিনি: ১০। সংলাপ: ৯। সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, প্রতিটা কলাকুশলীর অসাধারণ অভিনয়। আর  আফরান নিশোর দুর্দান্ত অভিনয় তো আছেই। 

[২] তাকদীর: চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় নিয়ে বলার কিছু নাই। বাংলা টিভি মিডিয়ায় তিনিই সম্ভবত এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেতা। তাকদীর সিরিজটির কাহিনী ভালো। ব্যতিক্রমধর্মী কিন্তু বাস্তবসম্মত। এই ধরনের কাহিনীতে বিনোদন কম, তাই অনেকেই এটি পরিচালনা করার সাহস করতেন না। পরিচালক এই ধরনের একটি কাহিনীর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা ও কারিগরি দক্ষতা দেখিয়েছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে কেউ কেউ খুব ভালো অভিনয় করেছেন। সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছেন পার্থ। আমার ধারণা, বাংলা মিডিয়ায় সবচেয়ে আন্ডাররেটেড অভিনেতা হচ্ছেন পার্থ। সোলসের গায়ক পার্থ হিসেবে তার এত বেশি পরিচিতি যে সেটা ছাপিয়ে অভিনেতা পার্থ হওয়া হয়তো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, অথবা তিনি চাননি। কিন্তু চাইলে পার্থ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে পারতেন বলে আমার ধারণা। তাকদীর সিরিজটিতে তিনি চঞ্চল চোধুরীকেও অভিনয়ে ছাড়িয়ে গেছেন। আমি তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। চঞ্চল চৌধুরীর সহকারী হিসেবে সোহেল মন্ডলও দুর্দান্ত অভিনয় করেছে। ভালো লেগেছে রিকিতা নন্দিনী শিমুর অভিনয়ও। এদের বিপরীতে মনোজ কুমার প্রামাণিক, সানজিদা প্রীতি, ইন্তেখাব দিনার প্রমুখের অভিনয় খুবই সাদাসিধে ও অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল মনে হয়েছে। এদের কাছ থেকে আরও ভালো অভিনয় বের করে আনতে পারলে ও কাহিনী আরেকটু শক্তিশালী করতে পারলে তাকদীর আরও ভালো লাগত। ওভারঅল রেটিং: ৯। অভিনয়: ৯। পরিচালনা: ৯। কাহিনী: ৯। সংলাপ: ৯। সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, পার্থ’র অভিনয়।

[৩] মহানগর: প্রায় গতানুগতিক কাহিনী হলেও পরিচালনার মুন্সিয়ানা এবং মোশাররফ করিম, মোস্তাফিজুর নুর ইমরান ও নাসির উদ্দিন খানের দুর্দান্ত অভিনয়ে উতরে গেছে মহানগর। কাহিনীতে কিছু টুইস্ট আছে, যেটিও পরিচালকের দক্ষতার নিদর্শন হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু পরিচালনা ভালো না হলে এটি একটি অতি সাধারণ বস্তাপচা আইডিয়ার কাহিনী সম্বলিত নাটক হিসেবে যেকোনো প্রাইভেট চ্যানেলের আরেকটি বাতিল প্রজেক্ট হতে পারত। আশফাক নিপুনের মতো বেশ নামকরা পরিচালক কাহিনী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ওটিটি যুগে আরেকটু উন্নত রুচির পরিচয় দেবেন সামনে, এই প্রত্যাশা করি। জাকিয়া বারি মম, লুতফর রহমান জর্জদের মতো বেশ নামডাকঅলা শিল্পীদের অভিনয় দুর্বলতা এই সিরিজের মান কমিয়ে দিয়েছে। আশফাক নিপুনের মধ্যে একদিকে যেমন বেশ সৃজনশীলতা আছে আবার অন্যদিকে এফডিসির টিপিকাল বাংলা সিনেমার পরিচালকদের মতো চকচকে চেহারা ও পোশাকের বাতিল কলাকুশলীদের দিয়ে কাজ করানোর প্রবণতাও লক্ষণীয়। এই দিকটি বাদ দিলে তিনি সামনে আরও ভালো কাজ করতে পারবেন আশা করা যায়। ওভারঅল রেটিং: ৭.৫। অভিনয়: ৮। পরিচালনা: ৮। কাহিনী: ৬। সংলাপ: ৬। সবচেয়ে শক্তিশালী দিকÑ মোস্তাফিজুর নুর ইমরান ও মোশাররফ করিমের অভিনয়। 

[৪] বোধ: বেশ দুর্বল ও গতানুগতিক একটি কাহিনীকে পরিচালনার মুন্সিয়ানা দিয়ে উতরে দিয়েছে অমিতাভ রেজা চৌধুরী। আফজাল হোসেন তার চরিত্রানুযায়ী ভালো অভিনয় করেছেন। কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি শাহজাহান সম্রাটের অভিনয় দেখে। বলা যায় থ মেরে গিয়েছি তার অভিনয় শৈলীতে। ভালো অভিনয় করেছেন সারাহ আলম, অর্চিতা স্পর্শিয়া, খায়রুল বাশারও। অভিনয়ে উতরে যেতে পারেননি রওনক হাসান। সিরিজটিতে একটা মেসেজ আছে। নাটক-সিনেমাতে যে বিনোদনের বাইরেও সমাজকে নাড়া দেবার বিষয় আছে সেই কারণে হলেও পরিচালক ধন্যবাদ পেতে পারেন। ওভারঅল রেটিং: ৭.৫। অভিনয়: ৯। পরিচালনা: ৮.৫। কাহিনী: ৫। সংলাপ: ৮। সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, শাহজাহান সম্রাটের অভিনয়। 
[৫] কারাগার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় তোলা কারাগারের কাহিনী অত্যন্ত দুর্বল। সংলাপ দুর্বল তার চাইতেও বেশি। পরিচালনা গতানুগতিক। অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরী, আফজাল হোসেন ও তাসনিয়া ফারিন ভাল করেছেন, কিন্তু তাদের করার মতো সুযোগ কম দিয়ে যাদের চরিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তারা দুর্বল কাজ করেছেন। ইন্তেখাব দিনার, বিজরি বরকতুল্লাহ, এস এফ নাইম জঘন্য অভিনয় করেছেন। অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক সংলাপ, একই সংলাপ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বারবার উপস্থাপন করা সিরিজটিকে দুর্বল করেছে। ক্যামেরার কাজ ভালো লেগেছে আর চমক লেগেছে একটি ভিন্নধর্মী কাহিনী নিয়ে কাজ করার ইচ্ছাটাকে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যুগের পর যুগ বাংলা টিভিতে গতানুগতিক নাটক দেখতে দেখতে কারাগার মানুষের কাছে একটা ধাক্কার মতো লেগেছে। সিজন-২ এ ভালো কিছু হবে এই প্রত্যাশা থাকলো। ওভারঅল রেটিং: ৬.৫। অভিনয়: ৭। পরিচালনা: ৭। কাহিনী: ৬। সংলাপ: ৫। সবচেয়ে শক্তিশালী দিক: কাহিনীর নাটকীয়তা, ক্যামেরার কাজ ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়