শাহাজাদা এমরান: আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া নীলফামারীর সেই একত্রিশ ঘন্টা নিয়ে আজ আপনাদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরছি।
আমি ১৯৯৪ সালের ২১ অক্টোবর কুমিল্লায় সাংবাদিকতার জীবন শুরু করি। গত ৩১ বছরে আপনাদের ভালোবাসাকে জীবনের পাথেয় করে পথ চলেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কতটুকু সাংবাদিকতা করতে পেরেছি, আবার কতটুকু পারিনি, একজন সংগঠক হিসেবে কতটুকু পেরেছি, কতটুকু পারিনি, তা বিচার করার ভার আমার প্রিয় কুমিল্লাবাসীর উপর ছেড়ে দিলাম। কুমিল্লার আপামর জনসাধারণের যে কোন বিচার আমি মাথা পেতে নিতে বাধ্য। কারণ, আমি আজকের যে ‘শাহাজাদা এমরান’ এটা কুমিল্লাবাসীর ভালোবাসার প্রতিদান।
আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। এরপরও যখনি সুযোগ পাই সহকর্মীদের নিয়ে সারা দেশ ভ্রমণ করার চেষ্টা করি। ভ্রমণ আমার এক সুখময় বিষয়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ জুন ২০২৫ শুক্রবার দিবাগত রাত ১২ টায় আমার বন্ধু সংবাদকর্মী তারিকুল ইসলাম তরুণকে নিয়ে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমি বরাবরের মতো এই সফরের খবরও ফেসবুকে বন্ধুদের জানিয়ে দেই।
পরে, ২৭ জুন শনিবার আমাদের গাড়ি নীলফামারীতে পৌঁছায়। যেহেতু, গাড়িতে আর কোনো যাত্রী ছিল না , তাই চালক আমাদেরকে পঞ্চগড় না নিয়ে নীলফামারীতেই নামিয়ে দেন। সেটিও আমি ফেসবুকে প্রকাশ করি। আমরা গাড়ি থেকে নেমে নীলফামারি পৌরমার্কেট সংলগ্ন আল-নূর নামে একটি রেস্ট হাউজে উঠি। এরপর নীলফামারীর ঐতিহাসিক 'নীলসাগর' দেখতে যাই এবং সেখানে ফেসবুক পেজ ‘কুমিল্লার জমিনে’ লাইভ করি। পরে সেখান থেকে নীলফামারী সদরে ফেরার পথে এক রিকশাচালকের জীবনের গল্প তুলে ধরি।
২৭ জুন শুক্রবার বিকেল ৩টায় আমরা শ্যামলী বাস কাউন্টারে কুমিল্লা ফেরার জন্য দুটি টিকিট কাটি। বাস ছাড়ার সময় ছিল বিকাল ৫টা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এরই মধ্যে নীলফামারী জেলা গোয়েন্দা বিভাগ আমাদের আটক করে। তারা আমাদেরকে নীলফামারী জেলা পুলিশ সুপারের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বলা হয়, কুমিল্লা থেকে কয়েকজন সাংবাদিক আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠিয়েছে।
আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো হল,
১. আমি নাকি কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা
২. আমি নাকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খানের ব্যক্তিগত পিএস
৩. আমি নাকি কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক এমপি বাহাউদ্দিন বাহার ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছি।
৪. আমি নিজেও নাকি সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারত যেতে নীলফামারী এসেছি।
আমি অতীতে এপেক্স ক্লাব, বাপা, নাটাব সংগঠনের যেসব প্রোগ্রাম করেছি, সেই প্রোগ্রামে যারা অতিথি ছিল, তারা সবাই নাকি আওয়ামী লীগের কর্মী এবং আমি নাকি আওয়ামী লীগের দোসর।
আমাকে নীলফামারীতে আসার কারণ জানতে চাইলে আমি কারণ ব্যাখ্যা করি। আমি তাদেরকে বিনয়ের সাথে বলেছি, আপনারা কুমিল্লায় খবর নেন, কুমিল্লার পুলিশ, এসপি, ডিসি, বিএনপি, জামায়াতসহ সবার সাথে যোগাযোগ করে খবর নেন আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য কিনা।
আমি বলেছি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে 'আমাদের কুমিল্লা পত্রিকা’ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘কুমিল্লার জমিন’ কী অবদান রেখেছে, তা আমার মোবাইলে দেখে যাচাই করুন। আমি কোনো রাজনৈতিক দল করি না। তারপরেও কুমিল্লার ৮০% মানুষ বলে আমি বিএনপি পন্থী সাংবাদিক। কারণ, আমার লেখায়, আমার কলমে বিএনপির মতাদর্শ উঠে আসে। আমি পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে দলীয় পরিচয় ওন না করলেও কুমিল্লার মানুষ বিশ^াস করে যে আমার কলম কিছুটা ডানপন্থা অবলম্বন করে।
তখন আমি দেখলাম, আমার বক্তব্য ডিবি পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করলেন। দ্বিতীয় ধাপে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তখন আমি স্পষ্ট ভাষায় বলেছি, আমি যদি আওয়ামী লীগ করে থাকি, আমি যদি বর্ডার পার করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য আসি , আমি যদি নাঈমুল ইসলাম খান সাহেবের পিএস হয়ে থাকি তাহলে প্রমান করুন, আমি ফাঁসির মঞ্চে উঠতে রাজি আছি।
তখন আমাকে বলা হলো, আমার বিরুদ্ধে কুমিল্লা থেকে নাকি কতিপয় সাংবাদিক তথ্য দিয়েছে। তারপরেও তিনি আমার কথা অত্যন্ত আমলে নিয়ে আমাদেরকে নাস্তা করালেন। তখন তিনি আমার লেখা ‘আঙ্কেল গেইটটা খোলেন না’- বইটা দেখে খুব প্রশংসা করলেন।
তৃতীয় পর্যায়ে নীলফামারীর পুলিশ সুপার মহোদয় আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আমরা আমাদের মতো করে উত্তর দিলাম। তিনি আমার গত ৭/৮ বছরের ছবিগুলো একে একে দেখাতে শুরু করলেন। আমি তাকে বিনয়ের সাথে বলেছি, আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। বিভিন্ন নেতাকর্মীর সাথে আমার ছবি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও তিনি সাবেক এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের সাথে আমার কোনো ছবি দেখাতে পারেননি। আমি আমার সিটি মেয়রকে একটি বই উপহার দিতেই পারি। আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আমার বিরুদ্ধে যাচাই করুন, আমার রাজনৈতিক পরিচয়।
এক পর্যায়ে তিনি আমাদেরকে অন্য রুমে পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে তদন্ত শুরু করেন। রাত ৩টায় আমি জানতে পারলাম, আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও পায়নি। রাত ৪টায় এসে বললো, আমাকে ঢাকা যেতে হবে।
৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩৬৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। ঢাকা ডিবি কার্যালয়ের ওয়ারী জোনে আমাদেরকে নিয়ে আসা হল। এখানে এসে দেখলাম, তিনজন ডিআইজি পদের লোক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন আমি বুঝলাম আমি কত বড় অপরাধী। ঢাকার যাত্রাবাড়ির মামলায় আমাকে ফাঁসানোর সকল রকম প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নিয়ে নিয়েছে।
সবার দোয়ার কারণে তারা আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকলেন। আমি সকল প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে একে একে দিয়েছি। আমি বলেছি, আমার বিরুদ্ধে যদি তথ্য-প্রমাণ সত্য হয় তাহলে আমাকে ফাঁসি দিবেন, কিন্তু না পেলে সেই কথিত সাংবাদিকদের বিচার আপনারা করতে পারবেন কিনা?
পরে আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আমার একমাত্র ছেলের আগামীকাল এইচএসসি পরীক্ষা। আমাদের দোষ না থাকলে যেন ছেড়ে দেন। আমি তাদেরকে বলেছি, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য আওয়ামী লীগের গুম, খুনের বিরুদ্ধে আমার কলম ছিল সুস্পষ্ট। ‘বিনা ভোটের উৎসব, কেন্দ্রে ভোটার অভাবে কুকুর খেলা করে’ - এই শিরোনামও আমি দিয়েছি অসংখ্যবার। ডিআইজি পদ মর্যাদার তিনজন অফিসার আমার ফেসবুক গেটে সত্যতা পেলেন।
পরে, তারা আমাকে ও তারিকুল ইসলাম তরুণ কে নিয়ে বিকাল চারটায় আবারো নীলফামারীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
রাত ১১ টায় নীলফামারী জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় আসার পর এখানকার ডিবি পুলিশ আমাদের বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমাদের জানালেন, আমাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
নীলফামারীর ডিবি পুলিশ আমার সাথে খুব ভালো আচরণ করেছে। পরে, নীলফামারীর জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের জেলা সভাপতি, একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিকসহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী সেখানে যান। আমি তখন নীলফামারীর পুলিশ সুপারকে সরাসরি বলেছি, “আমি আপনার বিবেকের কাছে একটি প্রশ্ন রাখলাম , যে অভিযোগে আমার সাথে এমন আচরণ করলেন, সে অভিযোগের প্রমাণ কী পেলেন?”
তখন তিনি কোনো যথাযথ জবাব দিতে পারেননি। নীলফামারীর জেলা পুলিশ সুপার এ সময় খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলেছেন এবং কুমিল্লা থেকে পাঠানো ছবিগুলো আমাকে দেখিয়েছেন। সেখানে একটি ছবি কুমিল্লার সাবেক মেয়র আরফানুল হক রিফাত যখন মেয়র ছিলেন, তখন কুমিল্লার গোমতীকে ‘হাতির ঝিল’ করার জন্য একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলাম বাপা কুমিল্লার পক্ষ থেকে ডা. মোসলেহ উদ্দিন ভাইসহ আমরা। সেই ছবিটি উপস্থাপন করে বলেছে আমি নাকি আওয়ামী লীগের দোসর!
আমরা সবাই মিলে সামাজিক কাজ করি। আমার ছেলের সাথে নাইমুল ইসলাম খানের ছবি দেখিয়ে বলেছে আমরা নাকি স্বপরিবারে আওয়ামী লীগ করি। যাই হোক ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে রাত ১১টায় আমাদের ছেড়ে দেয়।
আমার কাছে মোবাইল না থাকার কারণে কিছুই জানতাম না। যখন আমি ফেরার পথে দেশের সাহসী কণ্ঠস্বর ফেস দ্যা পিপলের সাইফুর রহমান সাগর ভাই আমাকে ফোন দেন, তিনি বলেন, আমার জন্য কুমিল্লার সকল মানুষ, সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণ ফেসবুকে আমার পক্ষে কথা বলছেন, দোয়া করেছেন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে সেখান থেকে বের হতে পারবো।
তখন নীলফামারীর এসপি আমাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বললেন“আপনার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা কেন এমন অভিযোগ করলো?”
আমি বললাম, আমরা কুমিল্লার সকল সাংবাদিক এক ও অভিন্ন। যার কারণে এখনো প্রেস ক্লাব আগের মত আছে। কিছু কতিপয় নামধারী সাংবাদিকের জন্য সবাইকে দোষী করতে পারেন না।
আমি কুমিল্লা ফেরার পথে মোবাইল হাতে নিয়ে চোখের পানি রাখতে পারিনি। সকল মানুষ আমার মুক্তির জন্য স্ট্যাটাস ও দোয়া কামনা করেছেন। আমি অবনত মস্তিকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক সময়ে বিপদে কুমিল্লার মানুষ যেভাবে পাশে ছিলেন। আমি সকলের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
কুমিল্লার শতকরা ৯৮ ভাগ সাংবাদিক আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এ ঋণ শোধ করতে পারব না। ফেস দ্যা পিপলের সাইফুর রহমান সাগর ভাই আমার মুক্তির জন্য নিরাপদে কুমিল্লা ফেরার জন্য যা করেছেন তার ঋন শোধ করতে পারব না। শুধু বলব,সাগর ভাই আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি।
আমি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ দাদার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই কুমিল্লার পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াছিন ভাই, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু ভাই ও তরুণ বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার ভাইয়ের প্রতি। যারা আমাদের বিপদের দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ধন্যবাদ দিয়ে বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই কুমিল্লা পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান ও কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মহিনুল ইসলামের ভাইয়ের প্রতি। তারা যদি শক্ত অবস্থানে না থাকতেন, তাহলে আজ আমি হয়তো যাত্রাবাড়ী কিংবা শনির আখড়ার হত্যা মামলায় জেলে থাকতাম।
আমি শেষ করার আগে একটি কথা বলতে চাই, যারা আমাকে বিভিন্ন ছবি দিয়ে যেভাবে বিতকির্ত করার চেষ্টা করেছেন, আপনারা দেখেন, কুমিল্লার মানুষ আমার পক্ষে কিভাবে দাঁড়িয়েছে।
দয়া করে আর কখনো এমন করবেন না। আমি আপনাদের ক্ষমা করে দিলাম। আমি কিন্তু আপনাদের নামগুলো জানি। কিন্তু প্রকাশ করলাম না।
কুমিল্লার ৯৯ ভাগ সাংবাদিক আমার মুক্তির জন্য কাজ করছিলেন, তখনো একজন আমার বিরুদ্ধে কমেন্ট ও স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছিলেন। আপনারা একবার চিন্তা করুন, এমন এক বিপদে আপনি পড়লে আপনার অবস্থা কেমন হবে।
আমাকে যারা মিথ্যা মামলায় অন্ধকার কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন-ভবিষ্যতে এমন করবেন না। যারা ঐক্যবদ্ধভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমিও আমার জীবনে সবসময় আপনাদের পাশে থাকব, ইনশাআল্লাহ।