আহসান হাবিব: মৃত্যুকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি জীবনকে। মৃত্যু অনিবার্য বলে অনেককেই বলতে শুনি মৃত্যুর মতো মহান কিংবা সুন্দর কিছু নেই। এই উচ্চারণ তাদের ভয় থেকে উত্থিত বলেই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে একবার বলছেন মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান আবার সেই তিনি বলছেন মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। মৃত্যু যদি শ্যামের সমান হয়, তাহলে মরতে চান না কেন? কারণ এটা তার মনের কথা নয়। মনের কথা হচ্ছে তিনি বাঁচতে চান। মৃত্যু সবকিছুর সমাপ্তি, সেখানে মহান বা সুন্দরের কিছু নেই। বরং জীবন সুন্দর এবং মহান হবার সুযোগ থেকে যায়। তবে বার্ধক্যকে আমি ভালোবাসি না। অনেকেই বলে প্রতিটি বয়সের নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। আছে হয়তো। শিশুকে দেখতে সবচেয়ে ভাল লাগে। তারুণ্য আমাদের চোখে নেশা ধরায়। যৌবন আমাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে উপভোগের কানায় কানায়। কিন্তু বার্ধক্য? এই সময় সবকিছু ভেঙে পড়ে। শরীর ভেঙে পড়ে, মন ভেঙে পড়ে। বিবিধ রোগ এসে শরীরকে জরাগ্রস্ত করে ফেলে। যাবতীয় সৌন্দর্য ভেঙে পড়ে। এমনকি একজন সৃজনশীল মানুষও আর কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। নিজের লেখার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। এই সময় সবচেয়ে অসৌন্দর্য হচ্ছে নতুনকে গ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা। প্রায়ই দেখা যায় এরা নতুন যেকোনো কিছুকে অবক্ষয় বলে হতাশা ছুঁড়ে মারে।
আমার মনে হয় মানুষের যা কিছু সৃজনশীলতা তার শ্রেষ্ঠগুলো যৌবনেই করা হয়ে যায়। যতো বয়স বাড়ে ততো চিন্তার ধার কমতে থাকে, পরিপক্কতার বদলে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। তাই বার্ধক্য একধরনের মৃত্যুই। আমার মনে হয় মানুষের জীবন আরো ছোট হওয়া ভাল ছিল। মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল আরও সহজভাবে। আর শিশু তরুণ কিংবা যুবকদের যেকোনো মৃত্যু অগ্রহণযোগ্য। মানুষের মৃত্যু হবে হঠাৎ। যৌবন শেষ তখনই তার মৃত্যু হওয়া উচিত। প্রকৃতির এই মৃত্যু ভাবনা এবং প্রক্রিয়া সুবিবেচনাপ্রসূত নয়, এটা তার খামখেয়ালিপনা। তার এই খামখেয়ালীপনার জন্যই মানুষের জীবনে নেমে আসে অসংখ্য দুর্যোগ। মৃত্যুকে ঘিরে প্রকৃতির এই অনিশ্চয়তা মানুষকে দার্শনিক বানিয়ে ফেলেছে। তারা মৃত্যু নিয়ে নানারকম মতামত হাজির করেছে। মৃত্যুকে শিখণ্ডী বানিয়ে কতো কতো ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে। তারা তাদের ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এখনো এবং মানুষকে বিভক্ত করা, শোষণ করা ইত্যাদি বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ এরা এই মৃত্যু পরবর্তী এক আজগুবি জগত আবিষ্কার করে এই নিয়ে নানা রূপকথা বানিয়ে চলেছে। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে এরা আবিষ্কার করেছে এক অলৌকিক শক্তির। শুধু তাই নয়, পরকাল নিয়ে যেসব ঘটনা তুলে ধরে একদিকে লোভ অন্যদিকে ভয়ের লোমহর্ষক কাহিনি ফেঁদে বসেছে, তার তুলনা নাই। মৃত্যু ধর্মীয় ব্যবসার একটি বড় পণ্য।
মৃত্যুকে ভালোবাসি না তার মানে এই নয় যে মৃত্যুকে বরণ করতে রাজী নই। আমি শুধু বলতে চাই মৃত্যুর কোনো মহিমা নেই, সব মহিমা জীবনের। আগেই বলেছি মৃত্যু সবকিছুর অবসান ঘটায়। আমরা যে মৃত্যুর পর মানুষকে মনে রাখি তার কারণ একটাইÑ জীবন। তখন আমরা তার জীবনের কথা বলি, তার কাজের কথা বলি। আবার আমি জীবনকে ভালোবাসি মানে লম্বা জীবনকে নয়। একটা মাঝারি জীবন, বড়জোর পঞ্চাশ হলেই সবচেয়ে উপযুক্ত হয়। এর বেশি হলেই জীবনকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। জীবন হোক সংক্ষিপ্ত, নিরোগ, সৃজনশীলতায় ভরপুর এবং উপভোগ্যময়। লেখক: ঔপন্যাসিক