সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী: মাত্র দশদিনের ব্যবধানে আলোচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস দু’বার আলোচনায় এলেন। প্রথমবার তিনি দাবী করলেন, ২০০৬ সালে নোবেল কমিটি তাঁকে এবং গ্রামীণ ব্যাংককে আলাদাভাবে পুরষ্কার দেয়। অর্থাৎ, তিনি অর্ধেক নোবেলজয়ী নন। রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস দাবি করেছেন, বাংলাদেশে একদলীয় শাসন চলছে এবং সাত জানুয়ারীর নির্বাচন ‘প্রধান বিরোধীদল বয়কট করে’; কারণ ওই দলের ‘শীর্ষ নেতারা কারান্তরীণ কিংবা নির্বাসনে আছেন’। এখানে উল্লেখ্য, এই প্রথমবারের মতো ইউনূস ‘প্রধান বিরোধীদল’ বিএনপির পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেন। অথচ তিনি নিজেও জানেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া অনাথ আশ্রমের টাকা তসরুপের অভিযোগে সাজা ভোগ করছেন এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমান একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে দশ-ট্রাক অস্ত্র সরবরাহের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক বছর যাবত ব্রিটেনে পালিয়ে আছেন। সোজাসাপ্টা ভাষায় বললে, তারেক একজন দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী। তিনি যদি নিজেকে নির্দোষ ভাবেন কিংবা আদালতের রায় সঠিক নয় মনে করেন, তাহলে তিনি দেশে ফিরে এসব আইনীভাবে মোকাবেলা করছেন না কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর মুহাম্মদ ইউনূসেরও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি কৌশলে সত্য গোপন করে বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে নির্দোষ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছেন। আর এটার মাধ্যমে ইউনুস তাঁর সাথে বিএনপির গোপন আঁতাতের বিষয়টা ওনার অজ্ঞাতেই প্রকাশ্যে আনলেন। যদিও অনেক আগে থেকেই ইউনুস বিএনপির লবিইস্ট হান্টার বাইডেনের পাশাপাশি ক্লিনটন পরিবারের প্রভাব ব্যবহার করে ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানামাত্রিক ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসের একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মুহাম্মদ ইউনূস ক্লিনটন পরিবারের প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অন্যতম ডোনার। সহজ ভাষায় ডোনেশনের অজুহাতে তিনি ক্লিনটন পরিবারের সহমর্মিতা পাচ্ছেন। মানে পুরো বিষয়টাই গিভ এন্ড টেইক। ক্লিনটন পরিবারের সাথে সম্পর্কের ফলে ইউনূস শুধু নোবেল পুরষ্কারই পাননি, বরং তিনি নানাভাবে লাভবান হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এতোসব কিছুর পরও হিলারী ক্লিনটনের নাম ব্যবহার করে ইউনূস হিলারীর সাথেও নিম্নমানের প্রতারণা করেছেন কথিত হিলারীপল্লী প্রকল্পের নামে। এই প্রতারণার অকাট্য প্রমাণ আমরা ব্লিটজ পত্রিকায় তুলে ধরেছি একাধিকবার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই বিষয়টা ব্যাপকভাবে দেশেবিদেশে তুলে ধরার কোনো ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। অথচ এটা করা গেলে খোদ হিলারী ক্লিনটন এবং ক্লিনটন পরিবারের অন্য সদস্যরা ইউনূসের আসল চেহারাটা জানতে পারতেন।
নোবেল পুরস্কারকে ঘিরে ইউনূসের দাবীর বিষয়টা বাংলাদেশের কোনো কথিত ফ্যাক্টচেকার খতিয়ে দেখেননি। কারণ এদের প্রায় সবাই বিএনপি কিংবা জামাত ঘরানার। কিন্তু যে কেউ নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে একটু ঢুঁ মারলেই দেখবেন, এই পুরস্কারের ইতিহাসে কখনোই দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কিংবা সংগঠনকে আলাদাভাবে পুরস্কার দেয়া হয়নি। বরং ওগুলো যৌথ পুরস্কার। কিন্তু অর্ধেক নোবেল বিজয়ী ইউনূসের জন্যে হয়তো বিষয়টা বিব্রতকর ঠেকছে, কারণ আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ইংরেজী পত্রিকা ব্লিটজ-এ বারবার তাঁকে অর্ধেক নোবেলবিজয়ী হিসেবে আখ্যায়িত করায় এখন আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যমও এটাই অনুসরণ করছে। একারণেই ইউনুস ভেবেছেন, অন্তত বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও যাতে তাঁকে অর্ধেক নোবেলবিজয়ী না বলতে শুরু করে তাই একটা মিথ্যে তথ্য দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করাটা জরুরী। আর এটা করে ইউনূস শেষতক জনসম্মুখে নিজেকে একজন নিম্নমানের মিথ্যুক হিসেবে প্রমাণ করলেন।
এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ করা দরকার। ২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কার নেওয়ার সময় ইউনূস ঘোষণা দেন পনেরো বছরের মাঝেই দারিদ্রকে তিনি জাদুঘরে পাঠাবেন। ওনার কথায় আপ্লুত হয়ে ব্রিটেনের গার্ডিয়ানসহ অনেক পত্রিকায় তাঁকে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন মেন্ডেলাদের সাথে তুলনা করে বলা হলো; ইউনূস হলেন দারিদ্র বিমোচনের মহীরুহ। কিন্তু আজ যখন গোটা বিশ্বেই দরিদ্র জনগোষ্ঠির সংখ্যা বাড়ছে, তখন ইউনূস রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়ে দারিদ্র জাদুঘরে পাঠানো সংক্রান্ত তাঁর ঘোষণার নিউজ লিংকগুলো মুছে দিচ্ছেন।
নোবেল পুরস্কার নেওয়ার সময় ইউনূষ সগর্বে তাঁর ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম উদাহরণ সুফিয়া বেগমের গল্প সবাইকে শোনান। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সুফিয়া বেগম নাকি বিত্তবান বনেছেন। নিজের জীর্ণ কুটিরের জায়গায় দোতলা দালান নির্মাণ করেছেন ইত্যাদি। এই গল্পটা ইউনূস অন্তত ত্রিশ বছর বিভিন্ন জায়গায় শুনিয়েছেন। অথচ ২০০৭ সালে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ব্লিটজ পত্রিকার রিপোর্টারকে সুফিয়া বেগমের সাক্ষাৎকার নিতে জোবাা গ্রামে পাঠালে আমরা জানতে পারি, ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে তিনি অনাহারে এবং বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। যে দালানটা ইউনূস সুফিয়া বেগমের বলে এতোকাল প্রচার করেছেন, এটার প্রকৃত মালিক দুবাই প্রবাসী জেবেল হোসেন। অর্থাৎ, যুগের-পর-যুগ ইউনূস নির্লজ্জের মতো একটা ডাহা মিথ্যে কথা বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত প্রচার করে গেছেন। একবারের জন্যেও কেউ বিষয়টা খতিয়ে দেখেনি। কারণ, দেশিবিদেশি মিডিয়া অনেক আগে থেকেই ইউনূসের মিথ্যাচারের আফিমে বুঁদ হয়ে আছে।
লেখাটা শেষ করবো গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিয়ে। একএগারো পরবর্তী সময়ে হিলারী ক্লিনটন ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে বিদেশে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করার মাধ্যমে ইউনুসকে ‘বাংলাদেশের নতুন নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। ২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল এ বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নতুন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। এতো বছর পর আবারও ওই একই নীলনক্সা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এবার ইউনুসের সঙ্গী হয়েছে বিএনপি, জামাত এবং একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি। রয়টার্সের সাক্ষাৎকার ওই চক্রান্তেরই অংশ। ইউনূস অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে মাতোয়ারা।
সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত জঙ্গিবাদ বিরোধী সাংবাদিক, কাউন্টারটেররিজম বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইংরেজি পত্রিকা ব্লিটজ-এর সম্পাদক।