কাজী জহিরুল ইসলাম: এই গ্রীষ্মে ঢাকার তাপমাত্রা অতি উষ্ণ হয়ে ওঠায় জনজীবন অতীষ্ঠ। আমি ভাবছিলাম ঢাকার সামাজিক তাপমাত্রার কথা। প্রকৃতির মতোই ঢাকার, আসলে পুরো বাংলাদেশেরই, সামাজিক তাপমাত্রা এখন চরম ভাবাপন্ন। বৃক্ষ নিধনের ফলে, জলাভূমি ভরাট করার ফলে, ক্ষেপেছে প্রকৃতি আর নৈতিক শিক্ষা নিধনের ফলে ক্ষেপেছে সমাজের তাপমাত্রা। আমার শৈশব, কৈশোরে কিংবা যৌবনের শুরুর দিকে, যতদিন দেশে ছিলাম, কখনো দেখিনি অতি অশিক্ষিত কোনো পুরুষ লোকও অচেনা কোনো নারীকে অসম্মান করে কথা বলেছেন কিংবা ক্রোধের বশে গায়ে হাত তুলেছেন, অশিক্ষিত হলেও এই শিষ্টাচার-বোধ তাদের ছিল যে নারীকে আঘাত বা অপমান করা যায় না। তারা হয়ত ঘরে তাদের জায়া, ভগ্নি, কন্যা এমনকি জননীকেও কটু কথা বলেন, অত্যাচারও করেন, সেক্ষেত্রে অধিকারের একটা দাবী হয়ত থাকত।
কয়েক বছর আগে দেখি নোয়াখালিতে একদল ছেলে-ছোকরা, সঙ্গে কিছু নারীও, একজন নারীকে সাপের মতো পিটিয়ে মারছেন। এমন কী মৃতদেহের ওপরও আরো কয়েকটি আঘাত করে নিশ্চিত হচ্ছেন দেহটি পুরোপুরি নির্জীব হয়েছে কিনা। ভিডিওটি দেখে আমি শুধু চোখের জল ফেলিনি ভীষণ অপমানিতও বোধ করেছি, বারবারই মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে আমার বিদেশি সহকর্মীরা এই দৃশ্য দেখে আমাকে তিরস্কার করছেন, এই দেশের মানুষ তুমি?
একটি দেশে নানান ধর্মের, মতের এবং রাজনৈতিক আদর্শের মানুষ থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হবে, আত্মীয়তা হবে, আবার তারা ভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা করবে, বিতর্ক করবে। দুই ভাইও ভিন্ন আদর্শের অনুসারী হবে, বিতর্ক করবে আবার এক টেবিলে বসে খাবে, এটিই সভ্যতা, এটিই শিষ্টাচার। কিন্তু এই দৃশ্য এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না। দেশের মানুষ ক্রমশ বিভক্ত হচ্ছে, চরম ভাবাপন্ন মানসিকতা পোষণ করছে, ভিন্ন মতের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছে, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে আঘাত করার জন্য সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকছে। সামাজিক তাপমাত্রার পারদ এইরকম অসহিষ্ণু পর্যায়ে উঠে গেলে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, সমাজের সকল কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে।
গত বেশ কিছু বছর ধরে পহেলা বৈশাখ এলেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নানান কথা শুরু হয়। হারাম, বেদাত, হিন্দুয়ানী আচার ইত্যাদি বলে একদল কট্টরপন্থী মুসলমান সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। আবার তাদেরকে মৌলবাদী, জামাত, রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ইত্যাদি বলে গালাগাল শুরু করেন আরেক পক্ষ। দুই পক্ষই মারমুখি এবং প্রতি বছর এই অবস্থার ক্রমশ অবনতিই হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে। এইরকম একটি অহিংস আনন্দ শোভাযাত্রা কী করে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়?
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আপনারা যারা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করেছেন কিংবা যারা ইন্দোনেশিয়ার মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন তারা জানেন ইন্দোনেশিয়ার মানুষের জীবনাচার রামায়ন, মহাভারতের জীবনাচার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জাভা ভ্রমণ করেন তখন তিনি এইসব দেখে বিস্মিত হন, মুসলমানের পুত্র-কন্যারা কী করে রামায়ন-মহাভারতকে তাদের জীবনের অনুষঙ্গ করে নিয়েছে?
আমার এক ইন্দোনেশিয়ান সহকর্মীর নাম কালী কৃষ্ণমূর্তি, তিনি একজন খাঁটি মুসলমান পুরুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ধর্মকে ওরা সংস্কৃতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেনি। এতে কী ওদের মুসলনিত্ব হালকা হয়ে গেছে? মোটেও না। মওলানা ভাসানী কি বলেননি, তোমরা ধর্মরে ভাষা ও সংস্কৃতির মইধ্যে আইনো না, ফুলের নাম কি তাইলে ফাতেমাচুড়া রাখবা? দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা যখন বের হলো কিছুদিনের মধ্যেই স্টাফদের কাছে নির্দেশ এলো "জল" শব্দটি লেখা যাবে না, সর্বত্র পানি লিখতে হবে। প্রুফ রিডাররা সব জল পানি করে দিল। এমনকি জায়গার নামটিকেও পানিপাইগুড়ি বানিয়ে দিল। দুই বঙ্গেই জল-পানির দ্বন্দ্বে কম রক্তের ধারা তো আর গড়াল না, এখন সময় এসেছে সহিষ্ণু হবার। সমস্যা যত বাঙালিদের মধ্যেই। সারা ভারতবর্ষের হিন্দুরা কিন্তু পানি বলছে, সালাম বলছে, শুকরিয়া বলছে। এইদিক থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা বরং কিছুটা উদার, এখানকার লেখক গোষ্ঠী দ্বিধাহীনভাবে সাহিত্যে জল শব্দটি ব্যবহার করছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনো হিন্দু লেখক কখনোই পানি শব্দটি লিখেছেন এমন চোখে পড়েনি।
পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা কিন্তু হিন্দুদের দেখলে আদাব বা নমস্কার বলে সৌহার্দ্য বিনিময় করে, বয়োজ্যেষ্ঠ হিন্দুদের দাদা কিংবা দিদি বলে সম্বোধন করে, কিন্তু দুই বাংলার হিন্দুদেরই আমি দেখেছি তারা মুসলমানদের দেখে কখনোই সালাম বলে না, বরং আদাব বা নমস্কারই বলে। বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলমানকে ভাইয়া বা আপা বলে না, দাদা কিংবা দিদিই বলে। এর একটি বড়ো কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের এলিট হিন্দুরা মনে করেন বাংলা হচ্ছে হিন্দুদের ভাষা। তারা এই ভাষাটিকে বিশ কোটি বাঙালি মুসলমানেরও যে ভাষা তা মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি এবং মুসলমানদের ব্যবহৃত যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকেছে সেগুলোকে বাংলা হিসেবে মেনে নিতে পারে না। এর হয়ত আরো একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে, তারা তো জানেই নিচু জাতের হিন্দুরাই ধর্মান্তরিত হয়েছে কাজেই নিচু জাতের লোকদের প্রতি কিছুটা অবজ্ঞা তো থাকবেই।
ফিরে আসি মঙ্গল শোভাযাত্রায়। কালক্রমে বাংলা নববর্ষ দেশের সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষ উদযাপনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটির বিরোধিতা না করেন আসুন সকলে মিলে এটিকে বরং সর্বমঙ্গল শোভাযাত্রা করে তুলি। সম্রাট আকবর এই পঞ্জিকার প্রবর্তক, আমির ফতেউল্লাহ শিরাজী পঞ্জিকাটি তৈরি করেন। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় মোঘল সম্রাটের পোশাক যুক্ত করতে পারি, টুপি যোগ করতে পারি। আকবর, শিরাজীর মুখোশ যোগ করতে পারি। পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু যোগ করতে পারে, এভাবে আমরা এই দিবসে একটি বিশাল আকারের সর্বমঙ্গল শোভাযাত্রা বের করতে পারি।
এভাবে নানান কিছু যুক্ত হয়ে হয়েই একটি দেশের একটি জাতির সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের এইসব অর্জনকে দূরে ঠেলে দেয়ার চিন্তাটা আত্মঘাতী পদক্ষেপ হিসেবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে। একইভাবে ধর্মভীরু মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে তাদেরকে এই কর্মসূচীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। আমাদের মূল লক্ষ হতে হবে বিভক্তি নয়, ঐক্য। তাহলেই জাতি হিসেবে আমরা এগুতে পারবো, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো।
লেখক: কবি, ভাষাশিল্পী
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২৩ এপ্রিল ২০২৪
আপনার মতামত লিখুন :