এল আর বাদল: আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসে তাতে কতটা পরিবর্তন এসেছে?
বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, আগে সরকারের সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সব জায়গায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে একটা দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। তবে এখনো দুর্নীতি যথেষ্টই আছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতিকে প্রোমোট করছে এমনটি নয়। তারা মনে করেন, এখন বিচ্ছিন্নভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতি রয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতাও দেখা যাচ্ছে না। -- ডয়েচেভেলে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে এনসিটিবিতে কাগজ সরবরাহে ৪০০ কোটি টাকা কমিশন নেয়ার অভিযোগ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া ডিসি নিয়োগে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ ওঠার পর তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবী ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও তদবির বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। তাদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে কারো বিরুদ্ধেই এখনো মামলা হয়নি।
গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের দুর্নীতিতে জড়ানোর বিষয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ারুল ইসলাম। ডয়চে ভেলেকে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সচিবালয়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে বিভিন্ন কর্মকর্তার রুমে ঘুরে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। তখন তার তদবির নিয়ে একটা রিপোর্ট করি। এ নিয়ে তখন আমাকে নানা ধরনের চাপ সহ্য করতে হয়েছে। কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তখন কেউ কারো দায় নিতে রাজি হয়নি। যাই হোক পরিস্থিতি সামলেছি। পরে তো দেখা গেল এই ব্যক্তি আরো বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন তো অনেক জায়গায় তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হচ্ছে।”
গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি পরিস্থতির শিকার।
দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আক্তার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।” যেসব উপদেষ্টার পিও বা এপিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেই উপদেষ্টাদের তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "একটা অভিযোগের তদন্ত যখন হয়, তখন এর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা মেলে, তাদের সবাইকেই মামলার আসামি করা হয়। ফলে বিষয়টির এখন তদন্ত হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের সবাইকেই মামলায় আসামি করা হবে।
-- এনসিপির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ--
শুধু কি গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ? এমন অভিযোগ আরো অনেক নেতার বিরুদ্ধেই। নিজ এলাকায় এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের শতাধিক গাড়ির বহরের মহড়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তার দলেরই আরেক নেতা ডা. তাসনিম জারা। সারজিস আলম ওই প্রশ্নের জবাবে তখন গাড়িগুলো তার আত্মীয়-স্বজনরা দিয়েছেন বলে দাবি করেন। গাড়ি ব্যবহার বিষয়ক আরেক সমালোচনার জবাবে আব্দুল হান্নান মাসউদ দাবি করেছেন, তার বিলাসবহুল গাড়িটি জামায়াতের এক ব্যবসায়ী নেতা তাকে দিয়েছেন।
এনসিপি আত্মপ্রকাশের দিন মানিক মিয়া এভিনিউতে জমকালো সমাবেশ এবং পাঁচতারা হোটেলে দলটির ইফতার পার্টিতে খরচের উৎস নিয়েও প্রশ্ন আছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দল চালাতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ‘ডোনেশন' নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে তারা কত টাকা নিয়েছেন এবং কাদের কাছ থেকে নিয়েছেন তা এখনো প্রকাশ করেননি। এছাড়া কয়েকজন নেতার বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার, রাতারাতি জীবনধারার পরিবর্তন, হেলকিপ্টারে ভ্রমণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি)-র একান্ত সচিবের কক্ষে তদবির করার অভিযোগ ওঠে এনসিপির সংগঠক (হবিগঞ্জ) নাহিদ উদ্দিন তারেকের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। ভিডিওতে তারেকের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সিনথিয়া জাহিন আয়েশাকেও দেখা গেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সাবেক সহকারি একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তারা সরাসরি এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও এনসিপি সমর্থিত হিসেবে পরিচিত। তাদের এসব অভিযোগও এনসিপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ওয়াসার আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগে সুপারিশ নিয়ে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুমকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। আওয়ামী লীগের পলাতম নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এরপর অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মানিকগঞ্জ জেলার যুগ্ম সদস্যসচিব মেহেরাব খান ও আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা এই নীতিতে অটল আছি যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে, সেজন্য আমাদের একটা শৃঙ্খলা কমিটি করা আছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
সার্বিকভাবে আমরা যেটা বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, সেখানে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে সেজন্য সংস্কার করতে হবে। এই সংস্কারের পক্ষে আমরা কথা বলছি। মাঠ পর্যায়ে যে দুর্নীতি হয়, সেটার যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় এবং বিচার হয় সেই কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। আরেকটা বিষয়, আমরা দল গঠনের আগে থেকেই অনেক বেশি প্রোপাগান্ডার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে আমরা চাই কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।