বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করার পর বা লম্বা সময় হাঁটার পর আমাদের ইচ্ছে করে ঢকঢক করে এক বোতল পানি পান করি। আবার কেউ কেউ আছেন যারা জিম থেকে বের হন মাথাব্যথা নিয়ে। তারা বুঝতে পারেন কেবল পানিশূন্যতার জন্যই নয়, বরং কিছু না খাওয়া পর্যন্ত এই মাথাব্যথা দূর হবে না।
ব্যায়ামের পর আপনি কী খাচ্ছেন বা পান করছেন, সেটি রোজকার ওয়ার্কআউটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি নিয়ে জানিয়েছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের চিফ ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান এবং ডায়েটেটিক্স অ্যান্ড নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান চৌধুরী তাসনিম হাসিন।
তিনি বলেন, 'ব্যায়ামের সময়, আমাদের পেশিগুলোতে চাপ পড়ে। প্রোটিন সেগুলোকে মেরামত করতে সাহায্য করে। এই সময়ে আমাদের বেশ শক্তি ক্ষয় হয় এবং কার্বোহাইড্রেট তা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা শুধু শরীরের জ্বালানি হিসেবে নয়, মস্তিষ্কের ঠিকঠাক কাজ করার জন্যও অপরিহার্য। এই কারণেই কিছু মানুষের ব্যায়ামের পরপরই মাথা ঘোরা বা মাথাব্যথার সমস্যা হয়। এর অর্থ তাদের শরীর কার্বোহাইড্রেট চাইছে।'
তবে একটি সুষম ওয়ার্কআউট পরবর্তী ডায়েটের জন্য আপনাকে বিদেশি প্রোটিন পাউডার বা কোনো নিয়ন রঙের প্রোটিন বারের পেছনে ছুটতে হবে না। আপনার যা প্রয়োজন, খোঁজ নিলে দেখবেন সেগুলো রান্নাঘরেই আছে।
পুষ্টিবিদ তাসনিম বলেন, 'সবচেয়ে সহজ বিকল্প হলো ওটস ও দই। অথবা দই-চিড়া কিংবা দইয়ের সঙ্গে মুড়ি। এগুলো সহজেই পাওয়া যায় এবং এতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং প্রোবায়োটিকসের মিশ্রণ থাকে।'
তার মতে 'প্রোবায়োটিকস' কেবল একটি অতি আলোচিত বিষয় নয়, এটি আসলে ভারসাম্যের বিষয়।
'ওয়ার্কআউটের পরে আমাদের পুরো শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, একইসঙ্গে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টেও। অর্থাৎ যে দীর্ঘ পথ দিয়ে খাদ্য চলাচল করে। এ সময় অ্যাসিড নিঃসরণ বেড়ে গেলে কারও কারও তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুধা লাগে, কারও অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়। দইয়ের মতো প্রোবায়োটিকস সত্যিই এক্ষেত্রে ভারসাম্য নিয়ে আসতে সাহায্য করে।'
যারা দইয়ের পরিবর্তে দুধ বেছে নেন, তারা চাইলে ঠান্ডা দুধের সঙ্গে কলা, বাদাম দিয়ে ওটস বা চিড়া খেতে পারেন, জানান এই পুষ্টিবিদ। এমনকি শুধু দুধ ও কলাও বেশ ভালো কাজ করে।
তিনি বলেন, কলা সহজে হজম হয় এবং প্রোটিন ও কার্বস উভয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। কলায় থাকা ফ্রুক্টোজ দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং শরীরের কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা পূরণ করে। এ ছাড়াও, কলায় পটাশিয়াম থাকে, যেটি শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যায়াম করলে আমরা ঘামের সঙ্গে পটাশিয়াম হারাই।
ঘামকে সুস্থতার জন্য গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে চান চৌধুরী তাসনিম হাসিন।
তিনি বলেন, 'যারা খুব ঘামেন, তাদের আমি তাদের হাল্কা নাশতার সঙ্গে এক গ্লাস খাবার স্যালাইন পান করার পরামর্শ দেবো। এক গ্লাস ডাবের পানি বা এক গ্লাস স্যালাইন সাধারণ পানির চেয়ে দ্রুত শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট প্রতিস্থাপন করে। আসলে, এটি আপনাকে আরও ভালোভাবে হাইড্রেটেড রাখে।'
এখন চারপাশে প্রোটিন পাউডার আর প্রোটিন বারের বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ না হওয়ার অনুরোধ করে বরং নিজেই প্রোটিন তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
'বাজারের কেনা পাউডার গুলে খাওয়ার চেয়ে প্রোটিন স্মুদি নিজেই বাড়িতে তৈরি করার পরামর্শ দেবো। দুধের সঙ্গে কলা, খেজুর, বাদাম বা অন্যান্য ফল মিশিয়ে ব্লেন্ড করুন। এটা যেমন সহজ, তেমনি অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।'
তিনি আরও বলেন, 'খেজুর বা কিশমিশও খুব কার্যকর। এগুলোতে পটাশিয়াম বেশি থাকে এবং শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।'
এসব পানীয় বা স্মুদি ছাড়াও কিছু শক্ত খাবার রয়েছে যা আপনাকে শক্তি যোগাবে।
'একটি ডিম সেদ্ধ হলো ওয়ার্কআউটের পরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্ন্যাকস বা নাশতার অন্যতম। যদি আপনি অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চিন্তায় থাকেন, তাহলে পরিশোধিত আটার রুটির পরিবর্তে লাল-আটার রুটি, হোল-গ্রেইন ব্রেড বা ব্রাউন ব্রেড যোগ করতে পারেন। ওটস, লাল চিড়া এবং অন্যান্য কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটও বেছে নিতে পারেন।'
আরেকটা বিষয় হলো সময় মেনে চলা। যেক্ষেত্রে সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ বড় ভুল করেন বা বিষয়টাকে গুরুত্ব দেন না।
তাসনিম হাসিন বলেন, 'ওয়ার্কআউটের অন্তত ৩০ মিনিট আগে এবং পরে পানি বা স্যালাইন ছাড়া আপনার কিছু খাওয়া উচিত নয়। কারণ ব্যায়ামের সময় রক্ত সঞ্চালন এমনিতেই খুব বেশি থাকে, এমনকি পেটেও। ওয়ার্কআউটের ঠিক পরেই খেলে হজম কঠিন হয়ে যায় এবং অস্বস্তি বোধ হতে পারে। তাই ব্যায়ামের পর আপনার শরীরকে শান্ত হতে অন্তত আধঘণ্টা সময় দিন।'
এত কথা পড়ে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ওয়ার্কআউটের পরে খাওয়ার বিষয়টি রসায়ন বইয়ের জটিল কোনো বিক্রিয়ার সূত্র। মূল বিষয়টা হলো, আপনার শরীর কেমন অনুভব করছে সেটা বুঝতে পারা। মাথা ঘোরা, ঘাম, ক্ষুধা বা তৃষ্ণা—কোন অনুভূতি হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া এবং প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও পানির সঠিক পরিমাণের দিকে খেয়াল রাখা।
আপনার নিজের রান্নাঘরের জিনিসপত্র, যেমন: এক বাটি দই, একটি সেদ্ধ ডিম, একটি কলা বা এক গ্লাস খাবার স্যালাইনই যথেষ্ট। এসব হয়তো ইনস্টাগ্রামে খুব লোভনীয় দেখাবে না, কিন্তু আপনার প্রয়োজন শরীরের চাহিদা পূরণ করবে। আর সেই কাজটাই তারা করবে দারুণভাবে। যার মাধ্যমে আপনি পাবেন সারাদিনের শক্তি, ওয়ার্কআউটের পর ফের কাজে ফেরার ইচ্ছাও।
সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা