চতুর্থ পর্ব
শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সংগ্রামের ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। কারণ তার প্রতারণার অস্ত্র অনেক বেশি এবং অনেক সূক্ষ্ম। শয়তান ও নাফসে আম্মারার সাথে যুদ্ধে জয়ী হলে যা মানুষের হস্তগত হয় তা যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবার পরাজিত হলে যে ক্ষতি হয় তাও অপূরণীয়। পৃথিবীতে সাধারণত যে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয় তাতে অর্জিত সম্পদও যেমন সীমিত আবার যা কিছু ক্ষতি হয় তাও সীমিত ও পরিমাণযোগ্য। কিন্তু মানুষ শয়তানের সাথে যুদ্ধে হয় স্বীয় দ্বীন ও মর্যাদাকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয় অথবা দুটোকেই হারায়। এজন্যই এ যুদ্ধকে জিহাদে আকবার বা বড় জিহাদ নামকরণ করা হয়েছে। যে মানুষ নিজেকে উপযুক্তভাবে প্রস্তুত না করেছে তার জন্য অভ্যন্তরের শত্রুকে পরাস্ত করা কঠিন এমনকি যদি এ শত্রু দুর্বলও হয়ে থাকে। যদিও শত্রু হিসাবে যদি শয়তানকে যাচাই করা হয় সে তেমন বড় শত্রু নয় কারণ যে মানুষ বুদ্ধি বিবেকের অধিকারী, ওহির ওপর নির্ভরশীল এবং আল্লাহর সাহায্যের ওপর নির্ভর করে এ ময়দানে নামবে সে পরাস্ত হবে না। অবশ্যই সে শয়তানের ওপর বিজয়ী হবে। আমিরুল মুমিনীন আলী (রা.) বলেন,‘শয়তানকে নাফসের সাথে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিরোধ কর এবং তার কথার বিরোধিতার দ্বারা তাকে পরাস্ত কর।’ (আমেদী, ১৩১০ হি., ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১৭)
হজরত আলীর (রা.) শিক্ষা দেয়া পদ্ধতি অনুযায়ী শয়তানকে পরাস্ত করার সহজতম পন্থা হল নাফস ও শয়তানের চাওয়া ও কামনার বিরোধিতার মাধ্যমে তার সঙ্গে সংগ্রাম করা। কেবল তখনই শয়তানের কৌশল ফলপ্রসু হবে না।
إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفاً
‘নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বলই থাকে।’ (সূরা নিসা: ৭৬)
কোন কোন ইবাদতকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে সর্বাঙ্গীনভাবে তা শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। হজ হল তার অন্যতম। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেন,
‘হজের সত্তা দুটি মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত: চিন্তা ও কর্মের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং দেহ ও মন দিয়ে তাগুত ও শয়তানকে প্রত্যাখ্যান। হজের সকল বিধান ও আচার এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম এবং এর জন্য ভূমিকাস্বরূপ। এটি প্রকৃতপক্ষে ইসলামের এবং সকল ঐশী দাওয়াত ও বাণীর নির্যাস।’ (খামেনেয়ী, ১৩৮৭, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৪)
ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনী হজের সকল বিধিবিধান ও আচার অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মানুষ ও জীন শয়তানদের সাথে সংগ্রাম বলে মনে করেন। তিনি তাঁর হজ বাণীর বিভিন্ন অংশে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন,‘হজ হল মহাসত্য আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া এবং হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদের (সা.) অস্তিত্বের বরকতে তাঁর দিকে হিজরত। সেইসাথে সকল মূর্তি, ও তাগুত এবং শয়তান ও শয়তানের সন্তানদের প্রতি না-বাচক উত্তর...
হাজারুল আসওয়াদ চুম্বন ও স্পর্শ করার সময় আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হন যে, তাঁর ও তাঁর রাসূল এবং পুণ্যবান ও স্বাধীন বান্দাদের শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করবেন এবং কোন অবস্থাতেই তাঁদের শত্রুদের আনুগত্য ও দাসত্ব করবেন না। মনে কোনরূপ ভয়ভীতি রাখবেন না। জেনে রাখুন আল্লাহর শত্রুরা এবং তাদের শীর্ষে বড় শয়তান (আমেরিকা) ভীতু...।
সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সায়ী করার সময় প্রাণপ্রিয় মাবুদ আল্লাহকে পাওয়ার চেষ্টায় রত হন। কারণ তাঁকে পেলে দুনিয়ার সকল কাক্সিক্ষত বস্তু তুচ্ছ হয়ে যাবে এবং মন থেকে সকল সন্দেহ ও সংশয় দূর হয়ে যাবে। সকল পাশবিক আশা ও ভয় বিলীন ও সব পার্থিব আসক্তি বিচ্ছিন্ন হবে। স্বাধীনতা বিকশিত এবং যে সব তাগুত ও শয়তান আল্লাহর বান্দাদের নিজেদের আনুগত্যের ও দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করেছে তাদের সকল চক্রান্ত নস্যাত হয়ে যাবে।
জ্ঞান ও মারেফাত নিয়ে মাশআরুল হারাম ও আরাফাতের ময়দানে প্রবেশ করুন। প্রতিটি মাওকেফ ও অবস্থানের স্থানে নিশ্চিত বিশ্বাসের সাথে মহান আল্লাহর এ সত্য প্রতিশ্রুতি যে, মুস্তাদআফীনরা পরিশেষে জয়লাভ করবে (সবার অন্তরে) এ বিশ্বাসকে বর্ধিত করুন। নিরবভাবে ও স্থিরচিত্তে আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা করুন। আর সবসময় ঐ সব মানুষের মুক্তির চিন্তা করুন যাদেরকে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদিরা বঞ্চিত ও দুর্বল করে রেখেছে। আর হজের সব সম্মানিত স্থানগুলোতে মহান আল্লাহর কাছে তাদের মুক্তির পথ বাতলে দেয়ার দুয়া করুন।
অতঃপর মিনায় গিয়ে আপনাদের প্রকৃত কামনাগুলো কি হওয়া উচিত তাঁর দরবারে তা জানতে চান। মিনার কুরবানী হল সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে পরম প্রিয়ের জন্য উৎসর্গকরণ। মনে রাখুন, আপনাদের প্রিয় ও ভালবাসার সব বস্তুর মধ্যে নিজের প্রতি তীব্র ভালবাসা সবচেয়ে ক্ষতিকর, দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা এর থেকেই উৎসারিত হয়। এ ভালবাসাগুলো যেন আপনাদের পরম প্রিয়ের সান্নিধ্য লাভের অন্তরায় না হয়। এ চিন্তা করেই শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করুন।’ (খোমেনী, ১৩৮৭, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৪)
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনেয়ী শয়তানের সাথে সংগ্রামে সফলতার বিষয়টি হজের সব হারাম বিষয়গুলো মেনে চলার পাশাপাশি হাজীদের পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার শর্তাধীন বলে মনে করেন। তিনি বলেন,‘তাগুত ও শয়তানকে প্রত্যাখ্যান, নিজেকে প্রবৃত্তির হীন কামনা বাসনা থেকে দূরে রাখা, দৃঢ়চিত্ততা ও ধৈর্যের সাথে আল্লাহর সাহায্য কামনা এবং সার্বিকভাবে মুসলিম উম্মাহর বিশাল শক্তিকে কাজে লাগানোÑ এ সবই হজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আবশ্যক কিন্তু তা হতে হবে সামষ্টিক সমন্বিত পদক্ষেপ, চিন্তার অভিন্নতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং হজের প্রতিটি রুকন ও আমলের মধ্যে এর প্রতিফলন হতে হবে। (অন্যভাবে বললে) তাওয়াফ, সায়ী, আরাফাতের ময়দান, মাশআরুল হারাম ও মিনায় অবস্থান, সকল দিক থেকে একই লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা সব কিছুর মধ্যেই সামষ্টিক সমন্বিত পদক্ষেপ, চিন্তার অভিন্নতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে তবেই হজের লক্ষ্যে পৌছানো যাবে।’ (খামেনেয়ী, ১৩৮৭ ফার্সি সাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪)
মুসলিম বিশ্বের মহান এ নেতা শয়তান থেকে দূরে থাকা এবং শয়তানের প্রতারণামূলক কৌশলকে ব্যর্থ করাকে হজের অন্যতম ফল বলে মনে করেন। তাই তিনি নসিহত ও উপদেশ দিয়ে বলেন,
‘আমি হজের মহান সমাবেশে উপস্থিত সকল মুসলমান ভাই ও বোনের কাছে বিনয়ের সাথে আবেদন করছি যে, হজে চিন্তা করুন এবং ঐ দুই মূল বিষয়কেÑ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ ও তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ এবং সকল শয়তান ও তাগুতকে প্রত্যাখ্যানÑ অর্জন করুন এবং তাকওয়ায় সজ্জিত হয়ে, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও উজ্জল ভবিষ্যতের আশা নিয়ে... স্ব স্ব ভূমিতে ফিরে যান।’ (খামেনেয়ী, ১৩৭৪ ফার্সি সালে দেয়া হজ বাণী)
সিদ্ধান্তসমূহ
১. ইমাম খোমেনী ও আলী খামেনেয়ীর বিভিন্ন বক্তব্য ও বাণী থেকে স্পষ্ট হয় যে, হজ এমন একটি বিরল সুযোগ ও বিশেষ এক নিয়ামত যা আল্লাহ মুসলমানদের জন্য দিয়েছেন। মহানবি (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহে হজকে এক সুবর্ণ সুযোগ বলে অভিহিত করা হয়েছে যার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হওয়া বাঞ্ছনীয় নতুবা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং অনুশোচিত হতে হবে।
২. হজ মুসলমানদের জন্য অন্যতম যে সুযোগটি সৃষ্টি করে তা হল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র। এ ফরজ ইবাদতটি ইরানী হাজীদের জন্য ইসলামী বিপ্লবকে সকলের সামনে পরিচিত করানোর সুযোগ এনে দেয়। আর অন্য সব দেশ থেকে আগত মুসলমানদের জন্য এ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় যে, তারা সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির প্রচার প্রপাগাণ্ডার ডামাডোল থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি ইসলামী বিপ্লবের বার্তাকে যা প্রকৃতপক্ষে ইসলামেরই বার্তা শুনতে পারে। তাই হজ তাদের মিথ্যা প্রচার ও গুজবগুলোকে নস্যাত করে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। হজ মুসলমানদের পারস্পরিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়। এতে তারা পরস্পরের পরামর্শে সেগুলোর সমাধানের উপায় বের করতে পারে। এছাড়া হজ মুসলমানদের সামনে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের সেই সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত করে যেগুলো ব্যবহার করে তারা মুসলমানদের পিছিয়ে রেখেছে, তাদের শোষণ ও সম্পদগুলো লুন্ঠন করছে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।
৩. হজ অন্যতম যে বিরল সুযোগটি হাজীদের জন্য সৃষ্টি করে তা হল তার মধ্যে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসচেতনতার ক্ষেত্র তৈরী করে যাকে কাজে লাগিয়ে সে আত্মগঠন করতে পারে। হজের আধ্যাত্মিক যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা হাজীকে অসচেতনতা ও উদাসীনতা থেকে বের করে আনে। মক্কা ও মদীনা এবং ওহি নাজিলের স্থানসমূহে বিদ্যমান আধ্যাত্মিক পরিবেশ হাজীকে কুরআন, দুয়া ও মুনাজাতের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহিত করে। এর ফলে সে শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষার প্রশিক্ষণ পায় ও নাফসে আম্মারার বিরুদ্ধে জিহাদে আকবারে রত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
ফার্সি থেকে অনুবাদ : এ. কে. এম. আনোয়ারুল কবীর