শিরোনাম
◈ প্রতিটি জেলা শহরে শিশু হাসপাতাল স্থাপন করা হবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ অব্যাহত থাকবে তাপ প্রবাহ ◈ আমেরিকান ক্লাব ইন্টার মিয়ামিতে যোগ দিচ্ছেন মেসি ◈ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সঞ্চালন লাইন, আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িক বন্ধ ◈ রম্য রচনার জন্য ডেইলি স্টারের কাছে মেয়র তাপসের ১শ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ◈ লক্ষ্মীপুরে ককটেল ফাটিয়ে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি, নিহত ১ ◈ কথা বলতে পারছেন না সিরাজুল আলম খান  ◈ বর্তমানে ১৬ দশমিক ২৭ লাখ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে: সংসদে প্রধানমন্ত্রী  ◈ কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশকে ৮৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার দিল বিশ্বব্যাংক  ◈ শহর বাঁচাতে সিএস দাগ অনুযায়ী খালের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে: মেয়র আতিক 

প্রকাশিত : ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৪:০৯ সকাল
আপডেট : ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৪:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মাওলানা মামলুক আলী নানুতবি (রহ.)

উপমহাদেশে ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞানের মোহনা

ইসলাম ডেস্ক: অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লির খ্যাতিমান আলেমদের অন্যতম ছিলেন মাওলানা মামলুক আলী নানুতবি। দিল্লি কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ায় ওই সময়ের বিশ্বখ্যাত আলেমরা ছিলেন তাঁর ছাত্র। তাঁকে ‘উসতাজুল কুল’ তথা ভারতবর্ষের আলেমদের শিক্ষাগুরু মনে করা হয়। ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ এই আলেম এতটাই দক্ষ ছিলেন যে দরসে নেজামির বেশির ভাগ পাঠ্য বই তাঁর মুখস্থ ছিল।

জন্ম ও শিক্ষা : মাওলানা মামলুক আলী (আনুমানিক) ১২০৪ হিজরি মোতাবেক ১৭৮৯ সালে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার নানুতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মৌলভি আহমদ আলী নানুতবি ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি ছিলেন মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরি (রহ.)-এর নানা। তাঁর বংশপরম্পরা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে মিলিত হয়। পারিবারিকভাবে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। সেই সময় মুফতি এলাহি বখশের দরসে ভিড় হতো সবচেয়ে বেশি। বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরি (রহ.) ও হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরি মক্কি (রহ.)-এর মতো কীর্তিমান ব্যক্তিরা ছিলেন সেই দরসের নিয়মিত ছাত্র। তাঁদের সঙ্গে মাওলানা মামলুক আলীও সেই দরসে অংশ নেন। এরপর শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি (রহ.)-এর কীর্তিমান ছাত্র মাওলানা রশিদুদ্দিন খান কাশ্মীরি (রহ.)-এর কাছে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করেন তিনি।

শিক্ষকতা : পড়াশোনার পর মাওলানা মামলুক আলী দিল্লিতে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৮২৫ সালের জুনে তিনি দিল্লির জাকির হোসাইন কলেজের আরবি বিভাগের প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন। ১৮৪১ সালের ৮ নভেম্বর একই কলেজের অধ্যক্ষ হন। তিনি সারা জীবন এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আরবি ভাষা, যুক্তিবিদ্যা, ফিকাহ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ পড়াতেন তিনি। তা ছাড়া সেখানে হাদিসের প্রধান ছয়টি গ্রন্থও পড়াতেন।

দিল্লির প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জাকির হোসাইন দিল্লি কলেজ ভারতের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এটি ১৬৯২ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি গাজিউদ্দিন খান ফিরোজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। তখন তা মাদরাসা গাজিউদ্দিন নামে পরিচিত ছিল। ভারতবর্ষে উর্দুকে একাডেমিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ১৭৯১ সালে মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে গেলে দুই বছর পর স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় পুনরায় চালু হয়। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ‘অ্যাংলো অ্যারাবিক কলেজ’ নামে তা পুনর্গঠন করে। ভারতভাগের পর এর নাম হয় দিল্লি কলেজ। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে ভারতের প্রেসিডেন্ট ও শিক্ষাবিদ ড. জাকির হোসাইনের নাম যুক্ত করা হয়। বর্তমানে তা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাকির হোসাইন মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে।

বরেণ্যদের চোখে : মাওলানা মামলুক আলী (রহ.) সম্পর্কে মাওলানা আশেকে এলাহি মিরাঠি (রহ.) লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজসংস্কারক শাহ আবদুল আজিজ (রহ.)-এর শাগরেদ মাওলানা রশিদউদ্দিন খানের কাছে তিনি পড়েছেন। মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.), মাওলানা কাসেম নানুতুবি (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ মাজহার (রহ.) ও মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবি (রহ.)-এর মতো উজ্জ্বল তারকারা এই মহান আলেমের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। দিল্লির দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সব জায়গায় গিয়ে হতাশ হয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আলেমরা তাঁর মতো জ্ঞানসমুদ্রের কাছে এসেছিলেন এবং দ্বিনি ইলম অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। (তাজকিরাতুল খলিল, পৃষ্ঠা ৯)

মাওলানা করিমুদ্দিন পানিপথি (রহ.) লিখেছেন, ‘তিনি ওই মাদরাসার উজ্জ্বল চালিকাশক্তি ছিলেন। ফারসি, উর্দু ও আরবি—তিন ভাষায় ছিল তাঁর দক্ষতা। এসব ভাষার সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল পূর্ণমাত্রায়। ইংরেজি থেকে উর্দু ভাষা অনূদিত বইয়ের বিষয় সম্পর্কে তাঁর আগে থেকেই অগাধ ধারণা থাকত। মাদরাসায় তাঁর শিক্ষার প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সময়ের জ্ঞানপিপাসুরা তাঁর কাছে এসে ভিড় করতেন।’ (তাজকিরাতু তাবকাতুশ শুয়ারা, পৃষ্ঠা ৪৬৩)

স্যার সাইয়েদ লিখেছেন, ‘ইসলামের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পাণ্ডিত্য ও স্মরণশক্তি এতই প্রবল ছিল যে সব বইয়ের ভেতরের সব লেখা হারিয়ে গেলেও তিনি স্মৃতিশক্তি থেকে তা পুনরায় লিখতে পারবেন। এসব গুণের পাশাপাশি তিনি ছিলেন ধৈর্যশক্তি ও সহমর্মিতার অনন্য প্রতীক।’ (আসারুস সানাদিদ : ৪/৭০)

জ্ঞানের সেবক : ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা মাওলানা মামলুক নানুতুবি (রহ.)-এর কাছে আসত। তৎকালীন সময়ে ইসলামী জ্ঞানজগতের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। কলেজে পাঠদানের পাশাপাশি অবসর সময়েও তাঁর ঘরে ভিড় করত ছাত্ররা। এই প্রসঙ্গে মাওলানা করিমুদ্দিন পানিপথি (রহ.) লিখেছেন, ‘তাঁর ঘর ছিল সব আলেম, ছাত্র ও শিক্ষকের মিলনমেলা। হিন্দুস্তানের দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ইলমপিপাসু ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে নিজের জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করত। তাঁর ঘরে আসা লোকদের তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন কিতাব পড়াতেন। তিনি এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে কোনো তালিবে ইলম তাঁর আচরণে কষ্ট পাবে, এমনটা কল্পনাতীত।’ (তাজকিরায়ে ফারায়েদুদ দাহর, পৃষ্ঠা : ১৮১)

উল্লেখযোগ্য ছাত্র : সব আলেমের শিক্ষক হওয়ায় তাঁর ছাত্রের সংখ্যা অগণিত। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণপুরুষ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.)। তাঁর কাছে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি (রহ.) এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সাইয়েদ আহমদ খান, মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবি (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ মাজহার নানুতুবি (রহ.), মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরি (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ থানবি (রহ.), মাওলানা জুলফিকার আলী দেওবন্দি (রহ.), মাওলানা ফজলুর রহমান দেওবন্দি (রহ.), মাওলানা করিম উদ্দিন পানিপথি (রহ.), শামসুল উলামা জিয়াউদ্দিন এলএলডি (রহ.), মাওলানা আলম আলী মুরাদাবাদি (রহ.), মাওলানা সামিউল্লাহ দেহলভি (রহ.)-সহ দেওবন্দ আন্দোলনের বেশির ভাগ ছিলেন সরাসরি ছাত্র।উল্লেখ্য, তাঁর ছাত্র মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর মাধ্যমে উপমহাদেশের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ এবং অন্য ছাত্র স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের হাতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশে দারুল দেওবন্দের মাধ্যমে নিখাদ ইসলামী জ্ঞান এবং আলীগড়ের মাধ্যমে আধুনিক ইসলামী জ্ঞানের প্রসার ঘটে। এ জন্যই তাঁকে ‘উস্তাজুল কুল’ সর্বধারার শিক্ষক বলা হয়।

ইন্তেকাল : ১২৬৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৫১ সালের ৭ অক্টোবর মাওলানা মামলুক আলী ইন্তেকাল করেন। দিল্লি গেটের পাশে অবস্থিত ‘মেহদিয়ান’ কবরস্থান তাঁকে দাফন করা হয়। এখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) এবং তাঁর পিতা শাহ আবদুর রহিম (রহ.)-এর কবরও আছে।

সূত্র : তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়