অজু ইসলামি জীবনের অন্যতম পবিত্রতা-বিধান। নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত কিংবা অন্যান্য ইবাদতের পূর্বে এটি শরিয়তের অপরিহার্য শর্ত। অজু যেসব কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ঘুম।
চিৎ, কাত বা হেলান দিয়ে ঘুমালে অজু পবিত্রতা আর থাকে না, নির্ধারিত ইবাদতের জন্য তখন আবার অজু করতে হয়।প্রশ্ন হলো, কেন ঘুম অজুকে ভঙ্গ করে?
এটি কেবল একটি ফিকহি বিধান নয়; বরং শরীর, মন ও আত্মার সম্পর্ক বোঝার গভীর নির্দেশনা।
অজুর অর্থ ও তাৎপর্য
“অজু” শব্দের অর্থ হলো পরিষ্কার হওয়া, আলোকিত হওয়া। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অজু করে ভালোভাবে অজু সম্পন্ন করে, তার গুনাহগুলো শরীর থেকে ঝরে যায়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৪)
অর্থাৎ অজু শুধু দেহের পরিচ্ছন্নতা নয়; বরং আত্মিক পবিত্রতার প্রতীকও বটে।
ঘুমের কারণে অজু ভঙ্গের মূল কারণ
ঘুম অবস্থায় মানুষের চেতনা ও নিয়ন্ত্রণ শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়, ফলে অজান্তেই বায়ু নির্গমনের সম্ভাবনা থাকে। ইসলামি শরিয়ত অজু ভঙ্গের অন্যতম কারণ হিসেবে বায়ু নির্গমনকে চিহ্নিত করেছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “অজু ভঙ্গ হয় তখনই, যখন কেউ বায়ু নির্গমন শোনে বা অনুভব করে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৬২)
অতএব, ঘুম এমন একটি অবস্থা যা বায়ু নির্গমন ঘটতে পারে কিনা—এই নিয়ন্ত্রণকে অনিশ্চিত করে তোলে। এজন্য ঘুম অজু ভঙ্গের সম্ভাবনাময় অবস্থা হিসেবে গণ্য হয়।
ফলে আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঘুমায়, সে যেন অজু করে নেয়।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২০৩; সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ৭৬)
তবে অন্য একটি হাদিসে আনাস (রা.) বলেন, “রাসুল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে বসতেন, তারা নামাজের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়তেন, পরে অজু না করে নামাজ আদায় করতেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৭৬)
এই দুটি হাদিসের মধ্যে আপাত বিরোধ নেই। প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে, যে গভীর ঘুমে পড়ে যায়, তার অজু ভেঙে যায়। দ্বিতীয় হাদিসে উল্লেখ, যে সামান্য তন্দ্রায় থাকে বা বসা অবস্থায় ঝিমায়, তার অজু নষ্ট হয় না।
এ–কারণেই ইসলামি আইনবেত্তাগণ ‘চিৎ, কাত, ঠেক ও হেলান’ দিয়ে ঘুমানোকে অজু ভঙ্গের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আলেমদের ব্যাখ্যা ও ফিকহি বিশ্লেষণ
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, “যে ঘুমে চেতনা সম্পূর্ণ হারায়, তার অজু ভেঙে যায়। কিন্তু বসা অবস্থায় অল্প ঘুমে অজু নষ্ট হয় না।” (শারহ সহিহ মুসলিম, ৪/৭৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)–এর মতে, “ঘুম যদি এমন হয় যে শরীরের অঙ্গ শিথিল হয়, তবে অজু ভেঙে যায়; কিন্তু বসা বা দণ্ডায়মান অবস্থায় তন্দ্রা হলে ভাঙে না।” (আল-হিদায়াহ, ১/৮৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ২০০০)
ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, “শুয়ে বা হেলান দিয়ে ঘুমালে অজু ভেঙে যায়, কিন্তু নামাজের অপেক্ষায় বসা অবস্থায় ঘুমালে ভাঙে না।” (আল-মুদাওয়ানাহ, ১/৩৪, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৯০)
অর্থাৎ আলেমগণ একমত যে, “গভীর ঘুম, যেখানে নিয়ন্ত্রণ হারায়, সেখানে অজু নষ্ট হয়; হালকা তন্দ্রায় নয়।”
ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুম ও নিয়ন্ত্রণবোধ
ঘুম হলো মানুষের এক প্রাকৃতিক অবস্থা, যা হাদিসে “মৃত্যুর ভাই” হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহই তোমাদের প্রাণগুলোকে গ্রহণ করেন যখন তোমরা ঘুমাও।” (সুরা যুমার, আয়াত: ৪২)
অতএব, ঘুমের সময় মানুষ নিজের শরীর ও চেতনাবোধের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারায়। এজন্য শরিয়ত এই অবস্থাকে অজু ভঙ্গের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হিসেবে দেখেছে।
তবে ইসলাম ঘুমকেও এক ধরনের ইবাদতের সঙ্গে যুক্ত করেছে। শোয়ার আগে অজু করা, নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করা, ডান কাতে শোয়া—এসবই রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতে অজু করে ঘুমায়, সে রাতে ঘুমের মাঝে আল্লাহকে স্মরণ করলে তার দোয়া কবুল হয়।” (সহিহ ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩৮৬২)
অতএব, ঘুমের আগে অজু করা এবং ঘুমের পর পুনরায় অজু করা—এই দুটিই আত্মাকে পবিত্র রাখার উপায়।
ঘুম হলো মানবদেহের বিশ্রাম, কিন্তু আত্মার জন্য এটি এক ধরনের অচেতনতা। শরিয়তের দৃষ্টিতে ঘুমের সময় দেহের নিয়ন্ত্রণ হারালে অজু ভেঙে যায়, কারণ তখন পবিত্রতার নিশ্চয়তা থাকে না।
ইসলাম মানুষকে শিখিয়েছে, “ঘুম থেকেও যেন সে জাগে পবিত্র অবস্থায়।” তাই মুসলমানের জীবনযাপন এমন হওয়া উচিত, যেখানে পবিত্রতা কেবল বাহ্যিক নয়, বরং ঘুম-জাগরণ—সব অবস্থায়ই আত্মিকভাবে বজায় থাকে। সূত্র: প্রথমআলো