শিরোনাম
◈ পাকিস্তান তালেবানে জ‌ড়া‌চ্ছে বাংলা‌দে‌শি তরুণরা, কিন্তু কীভাবে ◈ মানুষকে চেনা যায় তার কঠিন সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত দিয়ে, ভালো সময়ে নয়: অনুপম খের ◈ যে কারণে বিসিবির নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন তামিম ইকবাল ◈ এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক, রিয়া‌ল মা‌দ্রিদের দাপ‌টে কাইরাত হার‌লো ৫ গো‌লে ◈ ‘আল্লাহ তুই দেহিস’: জোর করে চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় এক আসামি গ্রেপ্তার ◈ সা‌কিব আল হাসান মন্ট্রিয়াল টাইগার্সের আইকন ক্রিকেটার ◈ ঢাকার ১৫‌টি ক্লাব ক্রিকেট বো‌র্ডের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না ◈ ট্রাক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে যানজট, ভোগান্তিতে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রীরা ◈ খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে ‘ধর্ষণের আলামত মেলেনি’: চিকিৎসক ◈ সংকটে থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের একীভূতকরণ: গ্রাহকের টাকা কতটা নিরাপদ?

প্রকাশিত : ০১ অক্টোবর, ২০২৫, ১১:০৫ দুপুর
আপডেট : ০১ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:১৯ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মাও থেকে সি চিন পিং: চীনের ৭৬ বছরের রূপান্তর ও যুক্তরাষ্ট্র কে তাড়িয়ে বেড়ানোর কৌশল

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চীনের বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ইতিহাস লেখা হলো। হাজার হাজার মানুষ এ স্কয়ারের দিকে ছুটছিলেন উত্তেজনা, আশা ও আগ্রহ নিয়ে। সেই সময় মাও সে তুং ঘোষণা দেন, ‘দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না ইজ স্ট্যাবলিশড!’ (গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলো)। শব্দগুলো যেন চীনের আকাশে এক নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিল। সেই থেকে শুরু একটি জাতির নতুন অধ্যায়ের।

কিন্তু এ নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা সহজ ছিল না। বহু বছর ধরে চীন অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন ও সামাজিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের নাগরিক—প্রত্যেকের জীবন ছিল চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা। কিন্তু সেই দীর্ঘ, জটিল ও রোমাঞ্চকর যাত্রার মধ্য দিয়েই চীন আজ বিশ্বশক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এভাবে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনের রহস্য ছিল—রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা, সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক কৌশল।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিপ্লবের পটভূমি

১৯১১ সালে চীনের চিং রাজবংশের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো গভীরভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ দারিদ্র৵সীমার নিচে বাস করত, বিশেষ করে গ্রামীণ চীনে। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা ছিল সীমিত, যা জনগণকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল। বিপরীতে প্রাদেশিক যুদ্ধবাজ নেতাদের ও স্থানীয় শক্তির প্রভাব ছিল অত্যধিক। এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার বিভাজন তৈরি করে।

চীনের অর্থনীতি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে বছরে ৯–১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল; যার ফলে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে আসে।

১৯২০-এর দশকে চীনের বড় শহর ও শিল্পকেন্দ্রে কুওমিনটাং (কেএমটি) দল প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে গ্রামীণ এলাকায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সমতার নীতি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে জনসমর্থন বৃদ্ধি করে সিসিপি।

১৯২৭ সালে শুরু হয় চীনের গৃহযুদ্ধ। কেএমটি এবং সিসিপির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব গ্রামীণ চীনের জীবনকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। ১৯৩৪-৩৫ সালে লংমার্চ সিসিপির নেতৃত্ব ও আদর্শ দৃঢ় করে এবং বিপুল জনসমর্থন নিশ্চিত করে। সিসিপির গ্রামীণ শক্তি আরও বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫)। এ সময়ে সিসিপি জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক নীতি কার্যকর করতে সক্ষম হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সূচনা ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন

১ অক্টোবর ১৯৪৯, তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সমবেত হন। মাও সে–তুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র (পিআরসি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাও ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চৌ এনলাই দায়িত্ব নেন। এ মুহূর্তটি চীনের ইতিহাসে এক বিরাট মাইলফলক হয়ে আছে। সে হিসাবে আজ ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৬ বছর পূর্তি।

বিশ্ব ভালো থাকলেই চীন ভালো থাকতে পারে। আর চীন ভালো করলে, বিশ্ব আরও ভালো হয়ে ওঠে: সি চিন পিং, চীনের প্রেসিডেন্ট

নতুন চীনের প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় কংগ্রেস, সামরিক ও বিচার বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিসিপির লক্ষ্য ছিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার সমন্বয়, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামাজিক নীতির বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ।

প্রথম কর্মসূচিতে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন এবং সামরিক সংহতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৫০ লাখ কৃষক নতুনভাবে জমি পান। প্রাথমিক শিল্পায়ন উদ্যোগে ১০০টি কারখানা পুনর্গঠন বা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্প্রসারণে প্রায় ১৫ হাজার নতুন বিদ্যালয় এবং ৫ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়।

সিসিপি সামাজিক নীতি প্রয়োগে নারীর ক্ষমতায়ন, শ্রমিক ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কৃষির উৎপাদন বাড়ে এবং শিল্পায়ন কর্মসূচি গ্রামীণ ও শহুরে—উভয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।

নতুন শিল্পায়ন উদ্যোগে তামা, লোহা, রাসায়নিক ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়, যা দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। সামরিক শিল্পও এ সময়ে বৃদ্ধি পায়। নতুন অস্ত্র কারখানা ও সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এ নীতি চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক কৌশল

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিআরসি) প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও চীনের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত-চীন বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে। চুক্তির মাধ্যমে চীন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন (৩০ কোটি) ডলারের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পায়।

শেনজেন শহরের জনসংখ্যা ১৯৮০ সালে মাত্র ৩০ হাজার ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের মধ্যে তা প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছায়। এটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সফলতার প্রমাণ।

পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সিসিপিকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করে। বিপরীতে তাইওয়ানকে সমর্থন দেওয়া হয় এবং জাতিসংঘে চীনের আসন নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। তবে ১৯৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলন চীনের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে।

১৯৭১ সালে চীন জাতিসংঘে আসন পায় এবং চীন সরকারের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে বাদ পড়ে তাইওয়ান। ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনা করে। এ সময় চীনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈশ্বিক কূটনীতিক শক্তি জোরালো হয়।

অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ ও নীতি পরিবর্তন

দেং জিয়াওপিং ১৯৭৮ সালে ক্ষমতায় এসে চালু করেন ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ নীতি। এ নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিবর্তে বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়। কৃষি খাতে ‘পারিবারিক দায়দায়িত্ব ব্যবস্থা’ চালু হলে কৃষকেরা উৎপাদনের এক বড় অংশ নিজেরা রাখতে ও বাড়তি অংশ বাজারে বিক্রি করতে পারেন।

এই সংস্কারের ফলে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বাড়ে। ১৯৮৪ সালের মধ্যে চীন শস্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে দ্বিগুণের বেশি হয় কৃষকদের গড় আয়।

আবার শিল্প ও বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্যে গড়ে ওঠে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কর সুবিধা ও অবকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ দিলে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে চীন পরিণত হয় বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) অন্যতম প্রধান গন্তব্যে।

১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকের মধ্যে বছরে ৯ থেকে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায় চীনের অর্থনীতি। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়তে থাকে, বিশেষ করে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে। উদাহরণ হিসেবে শেনজেন শহরের জনসংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল মাত্র ৩০ হাজার। এটি ১৯৯০ সালের মধ্যে বেড়ে প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছায়। এটাই প্রমাণ করে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চীনের শিল্প ও নগর উন্নয়নে কতটা কার্যকর ছিল।

চীনের এ বিস্ময়কর উত্থান নিয়ে দেং জিয়াওপিংয়ের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘বিড়াল সাদা না কালো, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো, সে ইঁদুর ধরতে পারে কি না।’

সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির উত্থান

১৯৯০-এর দশক থেকে চীন সামরিক আধুনিকীকরণে জোর দিতে শুরু করে। সামরিক বাহিনীকে পুরোনো অস্ত্রশস্ত্রের পরিবর্তে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানে এবং নৌবাহিনীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করা হয়। প্রতিরক্ষা বাজেটও বাড়তে থাকে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে।

চীন প্রথমবারের মতো বিমানবাহী রণতরীও তৈরি শুরু করে। ২০১২ সালে লিয়াওনিং বিমানবাহী রণতরী আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধ ও মহাকাশ কর্মসূচিতেও ব্যাপক বিনিয়োগ করে চীন।

প্রযুক্তি খাতে ২০০০-এর দশক থেকে চীন বিপুল অগ্রগতি করে। হুয়াওয়ে, লেনোভো এবং পরবর্তী সময়ে আলিবাবা ও টেনসেন্টের মতো প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে সরকারি বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা চীনকে রূপান্তরিত করে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে।

বিড়াল সাদা না কালো, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো, সে ইঁদুর ধরতে পারে কি না: দেং জিয়াওপিং, চীনের সাবেক রাষ্ট্রনায়ক ও বিপ্লবী

২০০৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো নিজস্ব নভোচারীকে (ইয়াং লিওয়েই) মহাকাশে পাঠায়। এর মধ্য দিয়ে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর কৃতিত্বের অধিকারী তৃতীয় রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় চীন। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো মহাশূন্যে হাঁটেন চীনা মহাকাশচারীরা।

চীনের বৈশ্বিক প্রভাব ও বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ

২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) ঘোষণা করেন। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্যিক এবং অবকাঠামোগত সংযোগ জোরদার করা। লক্ষ্য অর্জনে রেলপথ, বন্দর, সড়ক ও জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয় শত শত বিলিয়ন ডলার।

২০২০ সালের মধ্যে বিআরআইতে যুক্ত হয় ১৪০টির বেশি দেশ। মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন (১ লাখ কোটি) মার্কিন ডলার। আফ্রিকায় চীনের সরাসরি বিনিয়োগ ২০০৫ সালে যেখানে ছিল মাত্র ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলার, তা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলারে।

বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন পাকিস্তানের গওয়াদার বন্দর, আফ্রিকার কেনিয়ার রেলপথ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণে অর্থায়ন করে। এ প্রকল্প চীনকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করে।

এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, ‘বিশ্ব ভালো থাকলেই চীন ভালো থাকতে পারে। আর চীন ভালো করলে, বিশ্ব আরও ভালো হয়ে ওঠে।’

একই সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করে চীন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে চীন অন্যতম বৃহৎ সেনা প্রেরণকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেই সঙ্গে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় চীনের বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তীব্র হতে থাকে চীনের। প্রযুক্তি, সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ও প্রভাব বিস্তারের লড়াই শুরু হয়। হুয়াওয়ে ও টিকটকের মতো কোম্পানি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে।

চীনের বর্তমান অবস্থান

চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তার বিশ্বক্ষমতা অর্জনের মূল কারণ। সিসিপির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, শিল্পায়ন, কৃষক ও শ্রমিক ক্ষমতায়ন এবং আন্তর্জাতিক কৌশল চীনের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। দেশটির এমন উত্থান বড় হুমকি হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বেইজিংয়ের কল্পনাতীত প্রভাব রীতিমতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

চীনের ইতিহাস যেন সত্যিই এক রোমাঞ্চকর গল্প। একসময় দেশটি ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত। মানুষের জীবন ছিল কঠিন। স্কুলে যাওয়া, চিকিৎসা পাওয়া, এমনকি ছোট ছোট সুযোগও অনেকের কাছে ছিল দুঃস্বপ্ন। কিন্তু মাও থেকে সি—দেশপ্রেমী নেতৃত্ব চীনকে তুলে এনেছে সেই খাদের কিনারা থেকে। বদলে দিয়েছে পুরো দেশের মানুষের জীবনকে।

চীন শুধু দেশের ভেতরই শক্তিশালী হয়ে থাকেনি, ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চেও নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলেছে। আজ দেশটি শুধু বড় অর্থনীতিই নয়, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি; যেখানে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, সামরিক শক্তি সবই ঈর্ষণীয়, প্রভাবশালী।

এভাবে চীনের উঠে আসা একটি দেশের ইতিহাসের গল্পই নয়; বরং প্রত্যেকের জন্য প্রেরণাও। এটি শেখায়—যদি পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও উদ্যমের সঙ্গে কাজ করা যায়, তবে অনেক বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব। অনুবাদ: প্রথম আলো 

 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়