বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি) এতটাই সংকটে যে কর্মীদের বেতন পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে আমানতকারীদের টাকায়—এ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিতে উল্লেখ আছে। গত বছর ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৫৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা এবং খেলাপি বিনিয়োগ ৯৯.৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া কাগজে ঋণ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ও তহবিল আত্মসাতে ব্যাংকটি কার্যত ধসে পড়েছে। এখন এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ‘লাইফ সাপোর্টে’ টিকে আছে।
এই পরিস্থিতি শুধু এফএসআইবি’র নয়, অন্তত ডজনখানেক ব্যাংকের। ব্যাংকিং খাতের এমন সংকটকালীন সময়ে নজিরবিহীন এক উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে সংকটে জর্জরিত পাঁচটি বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক— ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক—একীভূত হয়ে গড়ে উঠছে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামি ব্যাংক। সম্পদের আকারে এটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে ঋণ ছাড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বিপুল এই ঋণের বড় অংশই খেলাপি, ফলে বহুদিন ধরেই ব্যাংকগুলো আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছিল।
ব্যক্তি আমানতকারীদের অগ্রাধিকার
নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের টাকা সুরক্ষায় বিশেষ পেমেন্ট স্কিম চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বিমার আওতায় দ্রুত ফেরত দেওয়া হবে। ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিলের দুই মাসের মধ্যেই এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। দুই লাখ টাকার বেশি আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে। একাধিক ব্যাংকে হিসাব থাকলেও সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্তই বিমার সুরক্ষা পাওয়া যাবে। একীভূত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে আমানতের বিপরীতে ৪ শতাংশ হারে রিটার্ন দেওয়া হবে। তবে সব পুরোনো আমানত স্কিম বাতিল হয়ে যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের নগদ অর্থের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
আমানতের নিরাপত্তা
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যেহেতু ব্যাংক অবসায়ন করা হচ্ছে না, তাই আইন অনুযায়ী আমানতকারী ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পুরো অর্থ ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আমানতকারীদের অর্থ নতুন ব্যাংকের হিসাবেই থেকে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমানত নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ব্যাংক তো বন্ধ হচ্ছে না, সব ব্যাংক মিলিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক হবে। তাই গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সঠিকভাবে একীভূতকরণ সম্পন্ন হলে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরতে পারে। তবে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কর্মীদের অনিশ্চয়তা
একীভূত প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রায় ২১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী তীব্র অনিশ্চয়তায় আছেন। শুধু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেই কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৬ হাজার জন। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে আছেন ২ হাজার ২০০ জন, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫ হাজার ৮০০ জন, এক্সিম ব্যাংকে ৩ হাজার ২০০ জন এবং এসআইবিএলে আছেন প্রায় ৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
কর্মীদের চাকরি রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা—তা নিয়ে সংশয় থাকলেও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেছেন, “চাকরি হারানোর ভয় নেই। প্রতিটি উপজেলায় নতুন শাখা খোলা হবে। ফলে নেটওয়ার্ক সোনালী ব্যাংকের পরেই অবস্থান করবে।”
আর্থিক অবস্থা ও অডিট
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমীন জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি ফরেনসিক অডিট চলছে। এতে যদি দেখা যায়, ব্যাংকগুলো স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকতে সক্ষম, তবে একীভূত হওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
তারল্য সংকটের পটভূমি
গত কয়েক বছর ধরেই এ ব্যাংকগুলো চরম তারল্য সংকটে ভুগছে। আমানতকারীদের আস্থা হারিয়ে আমানত প্রত্যাহারের হার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা সহায়তা সত্ত্বেও বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণের কারণে কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। ফলে একীভূতকরণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নতুন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকে পরিণত হবে। এতে মূলধন, সম্পদ ও আমানতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত হবেন।
নতুন ব্যাংকের মূলধন কাঠামো
একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের মোট সম্পদ দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকে, ৫ হাজার কোটি টাকা আসবে আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি) থেকে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদেশি সহায়তার ঋণও শেষ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে করদাতাদের অর্থ দিয়েই।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর আলোচিত পাঁচ ব্যাংকে আসে নতুন পর্ষদ। এর আগে এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে, আর বাকি চারটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের হাতে।
একাধিক আমানতকারী বলছেন, দুই লাখ টাকা ফেরত পাওয়া সাময়িক স্বস্তি দিলেও পূর্ণ আমানতের নিশ্চয়তা না থাকায় উদ্বেগ কাটছে না। তাদের দাবি— মূল অর্থ ফেরতের পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, একীভূতকরণ সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরতে পারে। তবে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ইউনিয়ন ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে এবং আমানতকারীদের আস্থা হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ব্যাংক সফল করতে হলে সবচেয়ে আগে লাগাম টানতে হবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে।
প্রশাসক নিয়োগ
পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য পুনর্গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ কর্মকর্তার নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। তারা হলেন— এক্সিম ব্যাংকে দায়িত্বে মো. শওকত উল আলম, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে মো. সালাহ উদ্দীন, ইউনিয়ন ব্যাংকে মো. আবুল হাসেম এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে মকসুদুল আলম।
তাদের দায়িত্ব হবে ব্যাংকের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন নির্বাহীকে পরিবর্তন করা। এসময় ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বোর্ড কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকবে।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। তবে একীভূত হওয়ার পর ডিলিস্ট করা হবে। যা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য এটি বড় ধাক্কা। ইতোমধ্যে ১০ টাকার ফেস ভ্যালুর শেয়ার নেমে গেছে ৫ টাকার নিচে। ফলে কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নয়, গোটা ব্যাংক খাতেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের বিতর্কিত নিয়ন্ত্রণ
এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অভিযোগ আছে, তারা ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিপুল ঋণ আত্মসাৎ করেছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যায়।
অবশেষে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হস্তক্ষেপে একীভূত হওয়ার পথে যাচ্ছে এই পাঁচ ব্যাংক।
নতুন নীতিমালা ও শরিয়াহ বোর্ড
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন নীতিমালা’ প্রণয়ন করছে, এতে বলা হয়েছে—কোনও ব্যাংক আর্থিকভাবে টিকতে না পারলে পুনর্গঠন, একীভূতকরণ বা অবসায়ন করা হবে। ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ড গঠন করতে পারবে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক নিয়মিত মূল্যায়ন করা হবে এবং ব্যর্থ হলে আগে সতর্কবার্তা, পরে কড়াকড়ি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভবিষ্যৎ চিত্র: সুরক্ষা নাকি নতুন ঝুঁকি?
একীভূত হওয়ার ফলে দেশে গড়ে উঠবে নতুন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামী ব্যাংক। সরকার বলছে, এ পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—দুর্নীতির শেকড় যদি কেটে ফেলা না যায়? রাজনৈতিক প্রভাব ও গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ বন্ধ না হলে? জবাবদিহি নিশ্চিত যদি না হয়? তাহলে নতুন ব্যাংকও পরিণত হতে পারে আরেকটি বড় সংকটের উৎসে।
উল্লেখ্য, পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের একীভূতকরণ নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ। সফল হলে গ্রাহকের টাকা সুরক্ষিত থাকবে, ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরবে। তবে এর সাফল্যের একমাত্র শর্ত হলো—স্বচ্ছতা, সুশাসন ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। অন্যথায়, নতুন ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে সাময়িক স্বস্তি মিললেও দীর্ঘমেয়াদে এর দায় পড়বে জনগণের ঘাড়েই। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।