মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এবার ১০০ বছরে পা রাখলেন। এ সময়ে তিনি তার আজীবনের অভ্যাস বজায় রাখলেন। অল্প খাবার খাওয়া, বেশি কাজ করা এবং বিশ্রামের লোভে না পড়ার মধ্য দিয়ে। জন্মশতবর্ষে তিনি আল জাজিরাকে বললেন, প্রধান বিষয় হলো আমি সব সময় কাজ করি। আমি নিজেকে বিশ্রাম দিই না। আমি সব সময় শরীর ও মস্তিষ্ক ব্যবহার করি। মন আর শরীরকে সক্রিয় রাখো, তাহলেই দীর্ঘায়ু হওয়া যায়।
রাজধানী কুয়ালালামপুরের দক্ষিণে পুত্রজয়ায় তার দপ্তরের ডেস্কে বসেই তিনি শতবর্ষের দিন কাটালেন অন্য দিনের মতোই- মালয়েশিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিশ্ব ঘটনাবলি, বিশেষত গাজার পরিস্থিতি নিয়ে লিখে। জন্মদিনের সময়ে সামান্য শারীরিক অবসাদ কাটিয়ে উঠে আল জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। বললেন, ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মমতা বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে থাকবে। তিনি বললেন, গাজায় প্রায় ৬৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। গাজা ভয়াবহ। তারা গর্ভবতী মা, সদ্যোজাত শিশু, তরুণ-তরুণী, পুরুষ-মহিলা, অসুস্থ ও দরিদ্রদের হত্যা করছে। এটা কি ভোলা সম্ভব? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ভোলা যাবে না।
গাজার যুদ্ধকে তিনি গণহত্যা আখ্যা দিয়ে এর তুলনা টানলেন ১৯৯০-এর দশকের বসনিয়ায় মুসলিম হত্যাকাণ্ড এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির হাতে ইহুদি নিধনের সঙ্গে। তিনি অবাক হলেন, ইসরাইলিরা নিজেরা গণহত্যার শিকার হয়েও অন্যদের ওপর একই বর্বরতা চালাচ্ছে। মাহাথির বলেন, আমি ভেবেছিলাম যারা এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তারা চাইবে না অন্য কারও সঙ্গে একই আচরণ করতে। কিন্তু ইসরাইলের ক্ষেত্রে আমি ভুল ছিলাম। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা অবস্থায় মাহাথির ছিলেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শোষণের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর।
তিনি আজীবন ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যদিও এ কারণে তাকে প্রায়ই ইহুদিবিদ্বেষী মন্তব্যের অভিযোগে সমালোচিত হতে হয়েছে। তিনি বলেন, ইসরাইলিরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেখেনি। তারা চায় যা তাদের সঙ্গে ঘটেছে, সেটাই আরবদের ওপর চাপিয়ে দিতে। সমাধান প্রসঙ্গে মাহাথির বলেন, একমাত্র যুক্তিসঙ্গত পথ হলো দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। তবে বাস্তবে তা কার্যকর হতে অনেক দেরি এবং তিনি নিজ জীবদ্দশায় তা দেখবেন না।
তিন দফা হার্ট অ্যাটাকের পরও বেঁচে থাকা মাহাথির মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা নেতা। তার ক্ষমতার মোট মেয়াদ ২৪ বছর। তার জন্ম ১০ জুলাই ১৯২৫ সালে, মালয়েশিয়ার কেদাহ প্রদেশে। তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮১ থেকে ২০০৩। চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন হয় তার ২০১৮ সালে, ৯২ বছর বয়সে। সর্বশেষ পদত্যাগ করেন ২০২০ সালে। ডাক্তারি পেশা থেকে রাজনীতিতে আসা এই নেতা মালয়েশিয়াকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে রূপ দেন। মাহাথির ১৯৭০-এর দশকে চীন সফরের স্মৃতি মনে করলেন- তখন দেশটি ছিল দরিদ্র, গাড়িও ছিল হাতেগোনা। অথচ আজ চীন বৈশ্বিক শক্তি, বিশেষত বৈদ্যুতিক গাড়িতে পশ্চিমকে টক্কর দিচ্ছে।
তিনি বলেন, চীন ১০ বছরের মধ্যে আমেরিকার সমান হবে। তারপর আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। চীন একাই ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়ে বড় বাজার। চীনারা পরিশ্রমী এবং ব্যবসায় খুবই দক্ষ। অন্যদিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নীতি নিয়ে সমালোচনা করেন। বলেন, আমেরিকায় উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে চাইলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ফলে আমেরিকা আর বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।
১০০ বছর বয়সেও মাহাথির প্রতিদিন হাঁটেন, ব্যায়াম করেন, অফিসে যান, অতিথিকে অভিবাদন জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন এবং বিদেশ ভ্রমণ করেন। দীর্ঘায়ুর রহস্য সম্পর্কে তিনি বলেন, শরীর-মন সক্রিয় রাখো, আর বেশি খেও না। আমার মায়ের সেরা উপদেশ ছিল- ‘খাবার যখন সবচেয়ে সুস্বাদু লাগে, তখন খাওয়া বন্ধ করো।’ অনুবাদ: মানবজমিন