এল আর বাদল : উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরে ঈদে মিলাদ-উন-নবী পালনের সময়ে 'আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার লাগানো নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এই ব্যানার লাগানোকে কেন্দ্র করে এফআইআর দায়ের হয়েছে, আবার তার বিরুদ্ধে উত্তর প্রদেশ সহ দেশের বেশ কয়েকটি শহরে মুসলমানরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
বিভিন্ন শহরে কয়েকটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন।
উত্তরাখণ্ডের কাশীপুরে রবিবার 'আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার নিয়ে মিছিল করার সময়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতি হয়েছে। এই ঘটনায় আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ---- বিবিসি বাংলা
আবার উত্তর প্রদেশের উন্নাওতে রবিবার একইরকম একটা মিছিল বেরনোর পরে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রকাশ করার কারণে পুলিশ মুসলমানদের নিশানা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কানপুরে কী হয়েছিল?
কানপুর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (পশ্চিম) দীনেশ ত্রিপাঠি এক বিবৃতিতে বলেছেন, "রাওয়াতপুর থানা এলাকায় মিলাদ-উন-নবীর চিরাচরিত শোভাযাত্রা বেরনোর কথা ছিল। যে জায়গা নির্ধারিত ছিল, তার বদলে এলাকার মানুষ অন্য এক জায়গায় প্যান্ডেল তৈরি করে আই লাভ মুহাম্মদ ব্যানার লাগিয়ে দেন। এক পক্ষের মানুষ এর বিরোধিতা করেন। পরে দুই পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে চিরাচরিতভাবে যে জায়গা ঠিক করা ছিল, সেখানে ব্যানার লাগিয়ে দেন।"
মি. ত্রিপাঠি দাবি করেছেন যে এফআইআর 'আই লাভ মুহাম্মদ' লেখার জন্য বা ব্যানার লাগানোর জন্য করা হয় নি, চিরাচরিত জায়গার বদলে অন্য জায়গায় প্যান্ডেল বানানোর জন্য এবং শোভাযাত্রা চলাকালীন এক পক্ষ অন্য পক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
এফআইআরে বলা হয়েছে যে 'আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার লাগিয়ে মুসলমান সম্প্রদায় নতুন রীতি শুরু করার প্রচেষ্টা করেছে এবং 'অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ' এর বিরোধিতা করেছেন। শোভাযাত্রার সময়ে যে পুলিশ কর্মীরা মোতায়েন ছিলেন, তাদের তরফেই এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এফআইআরে এটাও দাবি করা হয়েছে যে শোভাযাত্রা চলাকালীন 'অন্য সম্প্রদায়ের' ধর্মীয় পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। দুই 'সম্প্রদায়ের' মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি করা এবং ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগও করা হয়েছে এফআইআরে। শোভাযাত্রার আয়োজক সহ বেশ কয়েকজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে এফআইআরে।
কানপুর পুলিশ বলেছে যে এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয় নি।
স্থানীয় সাংবাদিক অভিষেক শর্মার কথা অনুযায়ী, ব্যানার লাগানো নিয়ে চৌঠা সেপ্টেম্বর বিতর্ক বেঁধেছিল আর পরের দিন মিলাদ-উন-নবীর দিনে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। কিন্তু এফআইআর দায়ের হয় ১০ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়।
কানপুরে 'আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার লাগানো নিয়ে এই বিতর্ক দানা বাঁধার পরে এআইএমআইএমের নেতা ও সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়েইসি ১৫ই সেপ্টেম্বর কানপুর পুলিশকে ট্যাগ করে এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, "কানপুর পুলিশ, আই লাভ মুহাম্মদ লেখা কোনও অপরাধ নয়। যদি তা হয়, তাহলে শাস্তি মেনে নেব।
গোধরা, মুম্বাই সহ বিক্ষোভ অন্য রাজ্যেও
আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার নিয়ে উত্তরাখণ্ড, গুজরাত আর মুম্বাই শহরেও বিক্ষোভ হয়েছে।
বিবিসির সহযোগী সাংবাদিক দখ্শেশ শাহ জানিয়েছেন, গুজরাতের গোধরায় একটি থানার সামনে গত শুক্রবার বিক্ষোভ আর ভাঙচুরের ঘটনায় ৮৭ জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে ১৭ জনকে।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সামাজিক মাধ্যমে বেশ অ্যাক্টিভ এক যুবক জাকির জাবা 'আই লাভ মুহাম্মদ' বিতর্ক নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেই একটা পোস্ট করেছিলেন। তারপর পুলিশ তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পুলিশ বলছে যে তারা মি. জাবাকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু তিনি থানা থেকে চলে যাওয়ার পরে আরেকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করেন, যেখানে তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে উৎপীড়ন আর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন। এর ফলেই স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
মুম্বাইয়ের ভায়খলা এলাকাতেও মুসলমানরা ২১শে সেপ্টেম্বর মিছিল বার করেছিলেন। সেখানেও বিনা অনুমতিতে মিছিল করার জন্য এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং একজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
উত্তরাখণ্ডের কাশীপুর শহরে রবিবার বিকেলে স্থানীয় মুসলমানরা 'আই লাভ মুহাম্মদ' ব্যানার নিয়ে মিছিল করেছেন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের হাতাহাতি হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক আবু বকর বলছেন, "ওই ঘটনার পরে পুলিশ মামলা দায়ের করে আর বাড়তি বাহিনী নামায়। গভীর রাত পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।"
কাশীপুর যে জেলার অন্তর্গত, সেই উধম সিং নগরের সিনিয়র পুলিশ সুপার মণিকান্ত মিশ্র বলছেন, "বিনা অনুমতিতে কাশীপুরে মিছিল করা হচ্ছিল। প্রায় চারশো মানুষ সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ওই ভিড় থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানো হয়। নাদিম আখতার সহ সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে আর অন্য দশজনকে আটক করা হয়েছে।
নাদিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা জানতে চেষ্টা করছি যে এই ধর্মীয় উন্মাদনার পিছনে আসলে কারা রয়েছে," বলছিলেন মি. মিশ্র।
মুসলমানদের নিশানা করা হচ্ছে ?
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে ছোট ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে মুসলমানদের নিশানা করা হচ্ছে এবং তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার চেষ্টা হচ্ছে।
সামাজিক সংগঠন 'ইউনাইটেড এগেইনস্ট হেট'-এর সদস্য নাদিম খান বিবিসিকে বলছিলেন, "বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে খবর পাচ্ছি যে পুলিশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। মোট কতগুলো এফআইআর হয়েছে বা কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সম্পূর্ণ তথ্য এখনও আমাদের হাতে নেই।
"কানপুরে যা ঘটেছে, তাতে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এরকম ঘটনা তো প্রথমবার হল না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। রমজান মাসে ঘরের ভেতরে নামাজ পড়ার জন্য মোরাদাবাদে মামলা হয়েছে। বাড়ির ছাদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া হয়েছে। এখন পয়গম্বরের পোস্টার নিয়ে মামলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুসলমানদের নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে তাদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে," বলছিলেন মি. খান।
কানপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে নাদিম খান বলছিলেন, "আই লাভ মুহাম্মদ ব্যানার ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে মুসলমানরা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কিন্তু তার ভিত্তিতে কোনও এফআইআর হল না, অথচ তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হল।
৩০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধেই কি মামলা হবে?
কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ইমরান প্রতাপগড়ী প্রশ্ন তুলেছেন যে যদি ইসলামের নবী মুহাম্মদের প্রতি ভালবাসা প্রকট করার জন্য মামলা করা হয়, তাহলে কি ভারতের ৩০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধেই মামলা করা হবে, কারণ প্রত্যেক মুসলমানই তো ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসেন।
তবে তিনি এও বলছেন যে বিনা অনুমতিতে মিছিল বার করা মুসলমান যুবসম্প্রদায়ের উচিত নয়, তাদের আইনের জালে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতে পারে।
মি. প্রতাপগড়ী বলছিলেন, "যদি আপনারা প্রতিবাদ করতে বা ধর্নায় বসতে চান, তাহলে তার জন্য অনুমতি নিন, অথবা প্রতিটা রাজ্য বা জেলাতেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর নির্দিষ্ট জায়গা থাকে, সেখানে বসেও প্রতিবাদ জানানো যায়। সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিবাদ করতে পারেন মানুষ।"
বিজেপি অবশ্য বলছে যে কারও ধর্মীয় পরিচয় দেখে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যারা আইন ভাঙ্গছেন, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উত্তর প্রদেশ বিজেপির মুখপাত্র রাকেশ ত্রিপাঠি বিবিসিকে বলছিলেন, "কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিশানা করা যায় না। আবার ধর্মীয় স্লোগান তুললেও কারও আপত্তি নেই। কিন্তু কোনও স্লোগান যদি আইনের সীমানা পার করে, তাহলে নিশ্চই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনও পোস্টার, ব্যানার বা স্লোগান কোথায় লাগাতে হবে তা দিতে হবে, তার জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে। সেই নিয়ম যদি কেউ ভাঙ্গে বা অনুমতি না নিয়ে পোস্টার-ব্যানার লাগায়, তাহলে তো ব্যবস্থা নেওয়া হবেই।
"জেনে বুঝে এক অভিযান চালানো হচ্ছে যাতে মানুষের অনুভূতি উসকিয়ে দেওয়া যায়, এটা অনুচিত," বলছিলেন মি. ত্রিপাঠি।
মুসলমানদের মধ্যে কেন এই প্রতিক্রিয়া?
কানপুরের ঘটনার পরে শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, অন্য বেশ কিছু রাজ্যে বিক্ষোভ হয়েছে। উত্তরাখণ্ড, মধ্য প্রদেশ আর গুজরাতেও 'আই লাভ মুহাম্মদ' ইস্যুতে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সামাজিক মাধ্যমে অনেক মুসলমান 'আই লাভ মুহাম্মদ' ছবি পোস্ট করছেন। বহু মানুষ এই ছবিটি নিজেদের প্রোফাইল পিকচার হিসাবেও লাগাচ্ছেন।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিবেক কুমার বলছিলেন, "মুসলমানদের নিশানা করে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে কোনও নীতি তৈরি করা হয়েছে বা কোনও বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। কিন্তু ছোট ছোট ঘটনা আর তার যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা থেকে টের পাওয়া যায় যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এরকম একটা মনোভাব গড়ে উঠছে যে তাদের পৃথক করে দেওয়া হচ্ছে। একটা সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে তারা দুর্বল," বলছিলেন মি. কুমার।
অধ্যাপক বিবেক কুমার এটাও বলছেন যে একটি সম্প্রদায়ে কেন এফআইআর দায়ের হওয়ার বিষয়টিকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন? এফআইআর হওয়ার পরে তাদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপরে আঘাত, এমনটাই বা তাদের কেন মনে হচ্ছে, প্রশ্ন অধ্যাপক কুমারের।