শিরোনাম
◈ রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি: কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক আজ, সনদ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে? ◈ সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তার এনসিপি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা ◈ নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় আসা কে এই সুশীলা কার্কি? ◈ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সতর্কবার্তা: বাংলাদেশ-নেপালে তরুণদের আন্দোলনে সরকার পতনের প্রসঙ্গ টেনে বিজেপিকে হুঁশিয়ারি ◈ কাতারের পর এবার ইয়েমেনে হামলা চালাল ইসরায়েল ◈ কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে সাময়িক বরখাস্ত ◈ ৯/১১ হামলার ২৪ বছর: নিহতদের স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রে শোক ও শ্রদ্ধা ◈ ৩৩ বছর পর ভোট জাকসুতে—ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৫ পদে লড়ছেন ১৭৭ প্রার্থী ◈ নরসিংদীতে তুচ্ছ ঘটনায় আপন দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা ◈ চিঠি লিখে ভারতকে একহাত নিলেন নেপালের পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৫:২৩ বিকাল
আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রাজনৈতিক শূন্যতার মুখে নেপাল, সামনে কী?

রক্তক্ষয়ী সহিংস বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলি। মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পৌডেলকে পাঠানো এক পদত্যাগপত্রে তিনি জানান, দেশের সংকট সমাধানের স্বার্থে এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমাধান বের করার উদ্দেশ্যে তিনি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াচ্ছেন। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে টানা সহিংস বিক্ষোভের মধ্যে ওলির এই পদত্যাগ আসে। বিক্ষোভকারীরা শুধু সরকারি স্থাপনাই নয়, রাষ্ট্রপতি পৌডেল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। ওলির পদত্যাগের পরও সহিংসতা অব্যাহত ছিল। অবশেষে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে এবং রাজপথে টহল দিচ্ছে। এমন অবস্থায় নেপালে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অস্থিরতার পেছনের কারণ

ভারত ও চীনের মাঝখানে স্থলবেষ্টিত নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তবে সর্বশেষ বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় গত সপ্তাহে, যখন সরকার ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও লিংকডইনসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নেপাল, সামনে কী?

সরকারের দাবি ছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম নেপালে কোনও অফিস বা প্রতিনিধিত্বকারী নিয়োগ দেয়নি। তবে সমালোচকেরা একে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত এবং সরকারের সমালোচক কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন।

এনজিও ফ্রিডম ফোরাম নেপালের চেয়ারম্যান তারা নাথ দাহাল বলেন, এটি ছিল এক অজনপ্রিয় সরকারের মরিয়া চেষ্টা, যাতে সমালোচকদের চুপ করানো যায়।

তবে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ শুধু নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নয়, বরং দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, কুশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণেরা, যাদের অধিকাংশই বেকার বা স্বল্প আয়ের চাকরিতে নিয়োজিত।

তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ

বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা বিলাসী জীবনযাপন করেন, অথচ সাধারণ তরুণেরা চাকরি ও ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এক তরুণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সংবিধানের বিরুদ্ধে নই। আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, অদক্ষ নেতৃত্ব এবং একই মুখগুলোর পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে।

তার দাবি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিক্ষোভে নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার এবং নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাবই তরুণ প্রজন্মের মূল লক্ষ্য।

সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

সোমবার কাঠমান্ডুর রাস্তায় লাখো মানুষ বিক্ষোভে নামে এবং সংসদ ভবন ঘিরে ফেলে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হন, আহত হন দেড় শতাধিক। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বুধবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২২ জনে পৌঁছেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নেপালের পরিচালক নিরঞ্জন থাপালিয়া বলেন, অবৈধভাবে প্রাণঘাতী ও কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার আমরা কঠোরভাবে নিন্দা জানাই। কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে।

চাপের মুখে মঙ্গলবার সকালে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। তবে ততক্ষণে ওলির পদত্যাগের ঘোষণা আসায় রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়। সেনাবাহিনী জনগণের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানালেও রাজধানীতে কারফিউ চলাকালেই বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নেপাল, সামনে কী?

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্বেগ

ভারত বলেছে, নেপালের রাজনৈতিক পক্ষগুলো যেন সংযম দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধান করে। অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে সংযম বজায় রাখা, মৌলিক অধিকার রক্ষা ও উত্তেজনা না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

রাজনৈতিক শূন্যতার শঙ্কা

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপাল এখন মারাত্মক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে। কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইন বিভাগের অধ্যাপক বিপিন অধিকারী বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সংবিধান স্পষ্ট সমাধান দেয় না। সম্ভাব্য পথ হতে পারে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা। সংসদ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় তরুণ প্রজন্মের দাবিগুলোকেও আলোচনায় স্বীকৃতি দিতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সি. ডি. ভট্ট আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, নেপালের সব প্রধান রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ হয়ে গেছে। আমরা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতায় প্রবেশ করেছি।

তার মতে, সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নেপালি সেনাবাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। তিনি বলেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সমর্থিত একটি বেসামরিক সরকারই একমাত্র কার্যকর সমাধান হতে পারে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নেপাল, সামনে কী?

মাঠে সেনাবাহিনী

বিক্ষোভে উত্তাল নেপালের পার্লামেন্ট ভবনের নিরাপত্তায় বুধবার সেখানে সেনা প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারিকে ঘিরে রাজধানীর রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে প্রায় জনশূন্য। 

বুধবার কাঠমান্ডুর বিমানবন্দর পুনরায় খোলা হয়েছে এবং রাজধানীর বেশিরভাগ বাসিন্দা কারফিউ মেনে চলায় পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল, তবে তখনও কিছু জ্বলন্ত ভবন থেকে ধোঁয়া উঠছিল।

সারা দেশে জারি করা কারফিউ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং সেনাবাহিনী সহিংসতা ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সহিংসতা ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এখন সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মঙ্গলবারের বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু নিউ বানেশ্বর সড়কে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সব চলাচলকারী যানবাহনের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করছেন।

সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজা রাম বাসনেত বলেন, আমরা প্রথমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

সেনাবাহিনী এক ঘোষণায় জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সমন্বয় করছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, কর্তৃপক্ষ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আলোচনা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নেপাল, সামনে কী?

আন্দোলন বেহাতের অভিযোগ

সেনাবাহিনী জেন জি বিক্ষোভকারীদের শান্তি আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের একজন প্রতিনিধি বিবিসিকে বলেছেন, ছাত্র নেতারা নতুন করে তাদের দাবির তালিকা তৈরি করছেন। তবে অনেক বিক্ষোভকারী আশঙ্কা করছেন যে এই আন্দোলন ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ হাইজ্যাক করেছে।

বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নেপালের জেনারেশন জি-এর আয়োজিত মঙ্গলবারের বিক্ষোভের একটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল: জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির অবসান দাবি করা। আমাদের আন্দোলন ছিল এবং এখনও অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিক অংশগ্রহণের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, তারা পরিস্থিতি দায়িত্বের সঙ্গে সামলানো, নাগরিকদের রক্ষা করা এবং সরকারি সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখার জন্য মাঠে সক্রিয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।

তারা আরও বলেছেন যে, বুধবার থেকে আর কোনও বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়নি এবং প্রয়োজনে কারফিউ কার্যকর করার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমাদের উদ্দেশ্য কখনোই দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করা বা অন্যকে আমাদের শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের অপব্যবহার করতে দেওয়া ছিল না।

সেনাবাহিনীও অভিযোগ করেছে যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করেছে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নেপাল, সামনে কী?

সামনে কী?

নেপাল এখন এক অজানা রাজনৈতিক পথে দাঁড়িয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দেশটিকে দীর্ঘ অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

অধ্যাপক বিপিন অধিকারী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পথ খোলা রয়েছে। তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু ক্ষমতা ভাগাভাগির বাইরে গিয়ে তরুণ প্রজন্মের দাবিগুলোকেও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সূত্র: ডয়চে ভেলে, বিবিসি, রয়টার্স

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়