শিরোনাম
◈ ফেরারি আসামিকে অযোগ্য ঘোষণা সহ একাধিক সংস্কার প্রস্তাব ◈ গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া আলী হুসেন ঢাবি থেকে বহিষ্কার ◈ বিনামূল্যে ২ লাখ টাকার আইটি কোর্স, যেভাবে করবেন আবেদন ◈ ২৯ বছর বয়‌সে মহানার্যমান সিন্ধিয়া রাজ্য ক্রিকেটের সভাপতি! থাকেন ৪ হাজার কোটি টাকার প্রাসাদে ◈ জাবিতে ছাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ, ২৮ বাস আটক ◈ সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল ঘোষণা নিয়ে নতুন তথ্য ◈ বাবাকে নজরবন্দি, ভাইদের আটক: সৌদি রাজতন্ত্রে যেভাবে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ বিন সালমান! ◈ পাকিস্তানে সমাবেশে বিস্ফোরণ, নিহত অন্তত ১৩ ◈ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন ◈ মালয়েশিয়ায় অভিবাসন-বিরোধী অভিযানে বাংলাদেশিসহ ৭৭০ অবৈধ অভিবাসী আটক

প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১১:২৫ দুপুর
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

বাবাকে নজরবন্দি, ভাইদের আটক: সৌদি রাজতন্ত্রে যেভাবে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ বিন সালমান!

বিবিসি: বাদশাহ আবদুল্লাহের মৃত্যুর পর সৌদি সাম্রাজ্যের নতুন বাদশাহ হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ।

শুরুতে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে পুত্র মুকরিন বিন আবদুল আজিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। সেসময় মুকরিন বিন আবদুল আজিজের বয়স ছিল ৬৮ বছর।

কিন্তু মাত্র তিন মাস পরই সালমান বিন আবদুল আজিজ বরখাস্ত করেন ছেলেকে। তার পরিবর্তে ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ওই জায়গায় আনেন। সম্পর্কে তিনি বাদশাহর ভাইপো। পাশাপাশি, ২৯ বছরের পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি।

প্রায় নয় বছর আগে যখন একের পর এক এসব ঘটনাবলী ঘটে চলছিল, সেসময় মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম সৌদি আরবের রাজনীতিতে কেউ শোনেনি। তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেনও না কেউ।

অন্যদিকে, মোহাম্মদ বিন নায়েফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল মার্কিন প্রশাসন। তিনি প্রতিরক্ষা বিষয়ে এফবিআইয়ের কোর্স করেছিলেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সন্ত্রাস দমন কৌশলের প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু ২০০৯ সালের অগাস্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। ওই হামলার জন্য সেসময় দায়ী করা হয়েছিল আল-কায়েদাকে।

সৌদি বাদশাহর 'দ্বার রক্ষক'

মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি এমবিএস নামে বহুল পরিচিত। লেখক ডেভিড বি. ওটাওয়ে তার বইয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান সম্পর্কে লিখেছেন, "প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি (মোহাম্মদ বিন সালমান) বাদশাহর গেট কিপার (দ্বার রক্ষক) হওয়ার জন্য নিজের পদকে ব্যবহার করতে শুরু করেন।"

উদ্দেশ্য ছিল বাবাকে নজরে রাখা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্রুতই মোহাম্মদ বিন সালমান তার বাবাকে পরিবার এবং তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের থেকে আলাদা করে ফেলেন। এমনকি এও বলা হয় যে বাদশাহকে তার স্ত্রী, মানে এমবিএসের মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে বাধা দেওয়া হয়।

ডেভিড বি ওটাওয়ের বইয়ে দাবি করা হয়েছে, "মোহাম্মদ বিন সালমান কার্যত তার মা এবং দুই বোনকে গৃহবন্দি করেন এবং বাবাকে এ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেতে দেননি।" "বাদশাহ নিজের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলেই বলা হতো চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে তাকে।"

ইয়েমেন আক্রমণ

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দ্রুতই নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তার তত্ত্বাবধানে, সে বছরেরই ২৬শে মার্চ হুথি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ইয়েমেনের রাজধানী সানাকে মুক্ত করতে হামলা চালায় সৌদি বিমান বাহিনী।

মি. ওটাওয়ে তার বইয়ে লিখেছেন, "প্রাথমিকভাবে, সৌদি জনগণ ওই হামলার প্রশংসা করেছিল। ভেবেছিল, শেষপর্যন্ত ইরানের সম্প্রসারণবাদী প্রবণতার বিরোধিতা করার সাহস দেখিয়েছে তাদের দেশ।"

"কিন্তু কিছু দিন পরে এ হামলা বাদশাহ, মোহাম্মদ বিন সালমান এবং সৌদি আরবের জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একে মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতির গাফিলতি হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে।"

মোহাম্মদ বিন নায়েফকে আটক

কাছাকাছি সময়েই তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে অপসারণ করে পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করার সিদ্ধান্ত নেন বাদশাহ সালমান।

রমজানের শেষের দিকে, ২০১৫ সালের ২০শে জুন রাতে রাজপরিবারের একাধিক সদস্য মক্কায় জড়ো হন।

সেই রাতে, রাজনৈতিক ও সুরক্ষা বিষয়ক কাউন্সিলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, যার সভাপতিত্ব করার কথা ছিল মোহাম্মদ বিন নায়েফের।

কিন্তু বৈঠক শুরুর কিছুক্ষণ আগেই তিনি একটি বার্তা পান। সেখানে বলা হয়েছিল বাদশাহ সালমান তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তড়িঘড়ি হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে বাদশাহের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাফা মহলে পৌঁছান তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার দুই বডিগার্ড।

লেখক বেন হাবার্ড তার বই 'দ্য রাইজ টু পাওয়ার, মোহাম্মদ বিন সালমান'-এ উল্লেখ করেছেন, "মোহাম্মদ বিন নায়েফ ও তার দুই রক্ষী বাদশাহের সঙ্গে দেখা করার জন্য লিফটে উঠেছিলেন। দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই বাদশাহের সৈন্যরা এগিয়ে গিয়ে নায়েফের রক্ষীদের অস্ত্র ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।"

"পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় নায়েফকে। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলে, তাকে বাধা দেওয়া হয় এবং ক্রাউন প্রিন্স পদ থেকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু তাদের কথা শুনতে নারাজ ছিলেন নায়েফ।"

নায়েফের পদত্যাগ

ওই রাতেই নায়েফকে গৃহবন্দি করা হয় এবং রয়্যাল কোর্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়্যাল কাউন্সিলের সদস্যদের ডেকে জানতে চান, তারা মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ বানানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত কী-না।

কাউন্সিলের ৩৪জন সদস্যের মধ্যে ৩১জন সদস্য সমর্থন জানান। তাদের ফোনকল রেকর্ড করা হয় এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফকে জানানো হয় তার কতজন আত্মীয় বাদশাহের এই সিদ্ধান্তে সমর্থন করেছেন।

লেখক বেন হাবার্ড তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "নায়েফ ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। কিন্তু সে রাতে তাকে ওষুধ দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত পরদিন সকালে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য তৈরি হয়ে যান।"

তাকে পাশের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে বাদশাহ সালমান ও তার গার্ডেরা ক্যামেরাসহ হাজির ছিলেন।

নায়েফকে অভ্যর্থনা জানান বাদশাহ এবং তার হাতে চুম্বন করেন। নায়েফ খুব নিচু স্বরে সালমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাদের এই সাক্ষাতের ভিডিও সৌদি টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসময় বারবার সম্প্রচার করা হয়।

"এরপর মোহাম্মদ বিন নায়েফ কক্ষ থেকে বেরােনোর পর অবাক হয়ে দেখেন যে তার রক্ষীরা সেখানে নেই। জেদ্দায় নিজের প্রাসাদে পৌঁছানোর পর তাকে সেখানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।"

নায়েফের নীরবতা

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রশ্নের জবাবে রয়্যাল কোর্টের একজন মুখপাত্র অবশ্য ওই রাত সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, জাতীয় স্বার্থে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়েছিল রয়্যাল কাউন্সিল। রয়্যাল কোর্ট আরও জানায় যে, তাকে বরখাস্ত করার কারণগুলো গোপন রাখা হয়েছে এবং সেগুলাে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।

ঘটনার প্রায় এক মাস পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সৌদি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, মরফিন ও কোকেনে আসক্ত থাকার কারণে তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাদশাহ।

ওই বছরের শেষের দিকে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। তার প্রতি এহেন আচরণ নিয়ে মোহাম্মদ বিন নায়েফ অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, ১৯৮৫ সালের ৩১শে আগস্ট জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ বিন সালমানের পোস্টার সৌদি আরবের সর্বত্র দেখা যায়।

মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি রাজপরিবারের অন্যতম যুবরাজ, যিনি বিদেশে পড়াশোনা করেননি। তিনি কখনোই সৌদি সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। তিনি রিয়াদের রয়্যাল অ্যান্ড সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করেন।

তার ইংরেজি শিক্ষক রশিদ সেকাই বিবিসিকে বলেছিলেন, "মোহাম্মদ বিন সালমান ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলেন। ইংরেজি পড়ার চেয়ে ওয়াকিটকিতে প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি আগ্রহ ছিল তার।"

স্নাতক হওয়ার পর ২০০৭ সালে সারা বিনতে মাশুরকে বিয়ে করেন। এই যুগলের চারটি সন্তান রয়েছে।

পিয়ানোতে ধ্রুপদী সুর

মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তাকে নিজের বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।

বইয়ে সে প্রসঙ্গে বেন হাবার্ড লিখেছেন, পুরো সন্ধ্যাটাই কেরির সঙ্গে কথা বলে কাটান মোহাম্মদ বিন সালমান। সেসময় সালমানের চোখ পড়ে সেখানে রাখা পিয়ানোর উপর।

জন কেরি তার কাছ থেকে জানতে চান, "আপনি পিয়ানো বাজাতে জানেন? পিয়ানোতে ধ্রুপদী সুর বাজিয়ে তাক লাগিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।"

"ঘরে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়েছিলেন। যেহেতু ওয়াহাবি ঘরানার মানুষেরা সঙ্গীত অপছন্দ করে, ফলে জন কেরি আশা করেননি যে মোহাম্মদ বিন সালমান পিয়ানো বাজাবেন।"

বিচারকের টেবিলে বুলেট

শুরু থেকেই যুবরাজ সালমানের ঝোঁক ছিল বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দিকে।

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস পর্যবেক্ষক রিচার্ড লেসি লিখেছেন, "মোহাম্মদ বিন সালমান তখনো ক্রাউন প্রিন্স হননি। রিয়াদে একটা মূল্যবান জমির উপর নজর পড়ে তার বাবার। কিন্তু জমির মালিক সেটা বিক্রি করতে চাইছিলেন না।"

"এ নিয়ে চাপ দিতে একজন বিচারকের কাছে যান মােহাম্মদ বিন সালমান। বিচারকও এ নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তখন মােহাম্মদ বিচারকের টেবিলে রিভলবারের একটা বুলেট রাখেন তিনি। ইঙ্গিত ছিল, বিচারক তার কথা না মানলে হয়ত তাকে গুলি করা হবে।"

যুবরাজের এহেন আচরণ সম্পর্কে বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছে অভিযোগ করেন বিচারক। এ খবর কখনাে অস্বীকার করেননি সালমান।

এরপর ২০১১ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহ যখন মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন, তখন তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে এমবিএস যেন কখনোই মন্ত্রণালয়ের ভবনে প্রবেশ না করে।

নারীদের গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা

মোহাম্মদ বিন সালমানের পিতা যখন সৌদি আরবের বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তার বয়স ছিল ৭৯ বছর। শোনা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরেই আলঝেইমার্স-এ ভুগছিলেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষমতার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি আরবের যুবক ও নারীদের মন জয় করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি ২০১৮ সালে নারীদের জন্য প্রচলিত ড্রেস কোড শিথিল করে বলেছিলেন, প্রকাশ্যে নারীদের 'আবায়া' পরার দরকার নেই।

সেই বছরই নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে তারা নিজেরাই কাজে বা কেনাকাটার জন্য গাড়ি চালিয়ে যেতে পারেন। যাতে এজন্য সঙ্গে পুরুষ মানুষ থাকার প্রয়োজন না হয়।

লেখক মার্ক থম্পসন তার 'বিয়িং ইয়ং, মেল অ্যান্ড সৌদি' শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, "অর্থনৈতিক কারণে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার জন্য নয়।"

তার মতে, "নারীরা পুরুষের অনুমতি ছাড়াই যাতে কাজ করতে এবং উপার্জন করা অর্থ ব্যয় করতে পারেন, সে কথা মাথায় রেখেই এই পদক্ষেপ।"

'শুরা'র সমাপ্তি

সৌদি আরব বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে 'শুরা' ও জ্যেষ্ঠ প্রিন্সদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঐতিহ্যে বিরাম টেনেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। 'শুরা' বলতে পরামর্শমূলক পরিষদকে বোঝায়।

তার বদলে, নিজেকে এক এবং একমাত্র শাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি। নিজের সিদ্ধান্ত ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা যে তিনি বরদাস্ত করবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

চেজ ফ্রিম্যান ১৯৯০-এর দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সৌদি আরবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন। তার মতে, "সৌদি রাজপরিবারের ঐক্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো শুরার ধারণার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা।"

বিলাসবহুল সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণ

ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার আগেও দামী সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণের জন্য পরিচিত ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি ৪৪০ ফুট লম্বা বিলাসবহুল ইয়ট কিনতে ৫০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন তিনি। তার আগে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম কেনার জন্য ৪৫ কোটি ডলার খরচ করেন তিনি।

সমালোচনা এড়াতে তিনি প্রথমে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ওই বিখ্যাত চিত্রকর্ম আবু ধাবির জাদুঘরে দিয়ে দেবেন। কিন্তু তেমনটা হয়নি। এর কিছুদিন পরই তার বিলাসবহুল নৗেতরী 'সেরিন'-এ দেখা যায় ওই চিত্রকর্ম।

একের পর এক গ্রেফতার, হারিরির পদত্যাগ

বলা হয়, সৌদি আরবে অন্তত ১০ হাজার জন প্রিন্স রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। এদের সকলকে সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ভাতা ৮০০ ডলার এবং এবং সর্বোচ্চ ভাতা পৗেনে তিন লক্ষ ডলার।

ক্রাউন প্রিন্স হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পরই এ ভাতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

২০১৭ সালের চৌঠা নভেম্বর মোহাম্মদ বিন সালমান সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগে প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩৮০ জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।

বেন হাবার্ড লিখেছেন, "এদের মধ্যে কমপক্ষে ১১জন প্রিন্স ছিলেন। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আদিল ফিকিয়া এবং অর্থমন্ত্রী ইব্রাহিম আবদুল আজিজও ছিলেন।"

"এদের সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং পাঁচতারা রিৎজ-কার্লটন হোটেলে নিয়ে গিয়ে গৃহবন্দি করা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা অর্থ সরকারকে ফেরত দেওয়ার পর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি তারা মোট ১০০ কোটি ডলার জরিমানাও দেন।"

একইভাবে সৌদি আরব সফররত লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরিকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেসময় ওই অভিযোগ ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়।

বেন হাবার্ড লিখেছেন, "আল-হারিরি মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করতে এলে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার গাড়ি বহরের থাকা ব্যক্তিদের বাইরে থাকতে বলা হয়। ওই কক্ষেই হারিরিকে পদত্যাগ করতে বলা হয়।"

"আল-হারিরি লেবাননের পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে পদত্যাগের ঘোষণা করেন এবং একটা বিবৃতি পাঠ করেন। সে বিবৃতি বিশ্বজুড়ে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল।"

তাকে বলতে শোনা যায়, তার পদত্যাগ লেবাননকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করে তুলবে। এই বিবৃতি পাঠের সময় তিনি বেশ কয়েকবার থামেন এবং এমন একটা ইঙ্গিত দেন যে ওই বিবৃতি তিনি নিজে লেখেননি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, "হারিরি যদি পদত্যাগই করতে চাইতেন, তাহলে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কেন পদত্যাগ করলেন?" এর কয়েকদিন পর আল-হারিরি দেশে ফিরে আসেন এবং তার সেই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এই অদ্ভুত ঘটনার নেপথ্যের কাহিনী অবশ্য কখনোই জানা যায়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৮ সালের মে মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, "সৌদি সরকার ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ২,৩০৫ জনকে আটক করেছে, যার মধ্যে ২৫১ জন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন এবং তাদের কখনো বিচারকের সামনে হাজির করা হয়নি।"

শুধু তাই নয়, নিউইয়র্কভিত্তিক 'কমিটি ফর দ্য প্রটেকশন অফ জার্নালিস্ট'ও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সৌদি আরবে ২৬ জন সাংবাদিক বন্দি রয়েছেন। এই সংখ্যা চীন ও তুরস্কের পর বিশ্বে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে এক হাজার সৌদি নাগরিকের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

জামাল খাসোগজি হত্যা মামলা

মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর ব্যাপার ছিল, যখন তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে গিয়ে এমবিএসের অন্যতম সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগজি খুন হন।

মি. খাসোগজি আরব নিউজ ও আল-ওয়াতানের মতো সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ বিন সালমান এক বছর যাবত ওই হত্যার দায় অস্বীকার করেন।

ডেভিড বি ওটাওয়ে লিখেছেন, "মোহাম্মদ বিন সালমানের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীর তত্ত্বাবধানে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তদন্ত শেষে সিআইএ এ সিদ্ধান্তে আসে যে, এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ স্বয়ং যুবরাজই দিয়েছিলেন।"

"যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) মোহাম্মদ বিন সালমানের একটা পুরনো রেকর্ডিং খুঁজে পায়, যেখানে তিনি সৌদি আরবে না ফিরলে খাসোগজিকে গুলি করার কথা বলেছিলেন।"

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক নোরা ডোনেল তাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, "আপনি কি খাসোগজিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন?"

উত্তরে মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, "একেবারেই না। এটা একটা জঘন্য অপরাধ। কিন্তু সৌদি আরবের নেতা হিসেবে আমি এর সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি। বিশেষতঃ যখন অপরাধীরা সৌদি সরকারের হয়ে কাজ করছিল।"

এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের এক আদালত সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যার দায়ে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়।

তবে, ২০২০ সালের ২০ মে প্রয়াত সাংবাদিকের পুত্র সালেহ খাসোগজি তার বাবার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়