বিবিসি বাংলার প্রতিদেবন।। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ থাকেন ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ায়। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়, সেখানকারই ভোটার ছিলেন তিনি। হঠাৎই ভোটার এলাকা পরিবর্তনের আবেদন করে হয়ে গেলেন ঢাকা-১০ আসনের ভোটার।
রোববার তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যেহেতু ঢাকা থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চান, সে কারণে তিনি ভোটার এলাকা পরিবর্তনের আবেদন করেছেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশ নিতে ওই এলাকার ভোটার হওয়ার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তাহলে তিনি কেন কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকার ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
এই প্রশ্নের জবাবে মি. মাহমুদ জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করার পরে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় থাকার পরিকল্পনা আছে তার।
নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ভোটারের ভোটার এলাকা পরিবর্তন করে অন্য এলাকা আসতে হলে তাকে সেই এলাকায় নিজের বাড়ি বা সম্পত্তি থাকতে হয়, অথবা ভাড়াটিয়াদের ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়ার রশিদসহ চার ধরনের তথ্য দিতে হয়।
কিন্তু, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যে বিধান রয়েছে তা লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ার সরকারি বাসায় থাকলেও ভোটার ফরমে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত আট বছর ধরে ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার একটি বাসায় থাকেন।
এসব বিষয় নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বক্তব্যের জন্য ফোনে যোগাযোগ ও ম্যাসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
আসিফ মাহমুদের ভোটার এলাকা পরিবর্তন নিয়ে ভোটার বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে যোগাযোগ করা হয় ধানমন্ডি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সাথে।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ওয়াজাহাত নূর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "এটি একান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না"।
মুরাদনগর টু ধানমন্ডি
সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বায়োগ্রাফিতে দেখা যায় ১৯৯৯ সালে তিনি কুমিল্লার মুরাদনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
২০১৮ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
আসিফ মাহমুদের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের আটই অগাস্ট উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই তিনি থাকেন ঢাকার মিন্টো রোডে মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসভবনে।
তবে, তিনি আগে থেকেই তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের ভোটার।
রোববার দুপুরে হঠাৎই গণমাধ্যমে খবর আসে ঢাকা ১০ আসনের অন্তর্ভুক্ত ধানমন্ডি এলাকার ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করবেন আসিফ মাহমুদ। দুপুরের পর তিনি আবেদনও করেন।
সোমবার নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সার্ভারে থেকে জানা যায় আবেদনের পরই আসিফ মাহমুদের ভোটার তালিকা পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি এখন ঢাকার ভোটার।
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের কারণ হিসেবে, আসিফ মাহমুদ তার আবেদন ফরমে উল্লেখ করেন কর্মস্থলজনিত কারণেই ভোটার এলাকা পরিবর্তন করছেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, ভোটার এলাকার পরিবর্তন কিংবা নতুন ভোটার করার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানা নির্বাচন অফিসার।
ধানমন্ডির থানা নির্বাচন কর্মকর্তা ওয়াজাহাত নুর। কিন্তু রোববার যখন আসিফ মাহমুদ ধানমন্ডি থানা নির্বাচন অফিসে যান তার কাগজপত্র গ্রহণ ও সেগুলো যাচাই বাছাই করতে দেখা যায় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব আব্দুর রশিদ মিয়াকে।
আসিফ মাহমুদের ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিবকে কেন সেখানে যেতে হলো? এই প্রশ্ন করা হয়েছিল মি. মিয়াকে।
জবাবে মি. মিয়া বিবিসি বাংলাকে জানান, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যক্তিগত সচিব তার বন্ধু। উপদেষ্টা ভোটার এলাকা পরিবর্তনের আবেদনে সহযোগিতা করতে যে কারণে তাকে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে তাকে ব্যক্তিগত সচিব অনুরোধ জানিয়ে এনেছিলেন ধানমন্ডি থানা নির্বাচন অফিসে।
ভোটার স্থানান্তরের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ার সরকারি বাসায় থাকলেও ঢাকা-১০ আসনের ভোটার হতে আসিফ মাহমুদ যে ফরম জমা দিয়েছেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন ঢাকা নিউ মার্কেট থানার অন্তর্গত কলেজ রোডের একটি বাসায় গত ৮ বছর ধরে ভাড়া থাকেন তিনি।
ধানমন্ডি থানা নির্বাচন অফিসের নোটিশ বোর্ডে একটি নোটিশ টানানো আছে। যেখানে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে হলে কী কী তথ্য ও কাগজ প্রয়োজন তার একটি তালিকাও দেওয়া রয়েছে।
সেই তালিকার প্রথমেই উল্লেখ করা রয়েছে, কোনো এলাকার ভোটার হতে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা অথবা আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে।
উপদেষ্টা মি. মাহমুদকে যে প্রত্যয়ন জমা দিয়েছে সেটিতে স্বাক্ষর রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তারই ব্যক্তিগত সচিব মো. আবুল হাসানের।
এছাড়াও নিয়ম অনুযায়ী, ভোটার এলাকা পরিবর্তন করতে যে বাড়িতে থাকেন সেই বাড়ির বিদ্যুৎ/পানি কিংবা গ্যাস বিলের কপি জমা দিতে হবে। জমা দিতে হবে বাসার হোল্ডিং ট্যাক্সের কপি ও বাড়িওয়ালার অনাপত্তিপত্র ও বাড়িভাড়ার রশিদ।
তবে, আসিফ মাহমুদের আবেদনের সাথে একটি বিদ্যুৎ বিলের কপি থাকলেও সেখানে বাসার হোল্ডিং ট্যাক্সের কপি কিংবা বাড়িভাড়ার রশিদ পাওয়া যায়নি।
এনিয়ে বক্তব্যের জন্য উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
ওই এলাকায় ভাড়া না থেকেও কীভাবে দ্রুত তার ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা হয়েছে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল ধানমন্ডি থানা নির্বাচন কর্মকর্তা ওয়াজাহাত নূরের কাছে।
জবাবে মিজ নূর বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, "প্রয়োজনীয় নথি জমা দেওয়ার পরই আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হয়।"
কোন দলের প্রার্থী হবেন আসিফ মাহমুদ?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরুতেই উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।
কয়েক মাসের মাথায় মি. ইসলাম উপদেষ্টা পদ ছেড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। তবে উপদেষ্টা পরিষদে থেকে যান আসিফ মাহমুদ।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসিফ মাহমুদ জানিয়েছিলেন, ঢাকার তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শেরেবাংলা নগর আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চান তিনি।
রোববার তিনি মুরাদনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-৩ আসন ছেড়ে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, কলাবাগান ও হাজারীবাগ থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০ আসনের ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন। পরিবর্তনও হয়েছে তার ভোটার এলাকা।
রোববার ধানমন্ডি থানা নির্বাচন অফিসে ভোটার এলাকা পরিবর্তনের আবেদন করার পর তার কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিল তিনি কি ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করবেন কি না।
জবাবে তিনি বলেছেন, ঢাকা থেকে তিনি নির্বাচন করবেন। তবে কোন আসন থেকে ভোট করবেন সেটি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে তিনি বলেন, "এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা স্বতন্ত্র নির্বাচন করারই, তারপরে দেখা যাক।"
সম্প্রতি বিএনপি ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। সারাদেশে যে ৬৩টি আসনে বিএনপি কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি তার মধ্যে ঢাকা-১০ আসনও রয়েছে।
তাহলে কি বিএনপির সমর্থন নিয়ে তিনি এই আসনে নির্বাচন করতে পারেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "আমার কারো সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। কেউ, রাজনৈতিক দল কোনো আসন ফাঁকা রাখলো কি রাখলো না সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি আমার সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগতভাবে, এককভাবেই নেব"।
এর আগে আসিফ মাহমুদ কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে নির্বাচন করার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। পরে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা থেকে নির্বাচন করার।
আসিফ মাহমুদ কী তাহলে বিএনপির সমর্থন পেতে যাচ্ছেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের কাছে।
জবাবে মি. আহমদ বলেছেন, এমন কোনো বিষয় তার জানা নেই। তবে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যারা ছিল তাদের সবার সাথেই বিএনপির রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে।
মি. আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে এমন মন্তব্য করলেও দলের অভ্যন্তরের আলোচনা রয়েছে যে, আসিফ মাহমুদ বিএনপি অথবা বিএনপি হাইকমান্ডের গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই ঢাকা-১০ আসনের জন্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মি. মাহমুদের নিজের জেলা কুমিল্লায়। গত এক বছরের সেখানে তার সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। কিন্তু ওই আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের বিষয়ে বিএনপি অনড় অবস্থান নেওয়ায় মি. মাহমুদ শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে কোনো পক্ষই এই সমস্ত তথ্যের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি।
ঢাকা-১০ আসনে তিনি বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন এমন খবরে বিএনপির ভেতরও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ওই আসনে, দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম। তিনি বিএনপির ভেতরে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।