মহসিন কবির: রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা হিসেবে প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটছে না। সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য হলেও গণভোটের সময়সূচি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একমত হতে পারছে না বিএনপি ও জামায়াত। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া এক সপ্তাহের আলটিমেটাম শেষ হলেও দলগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়নি।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার সম্ভাবনা নেই, দ্রুতই সিদ্ধান্ত জানাবে সরকার।
ফলে এখন প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই উদ্যোগ কোন পথে এগোবে?
সূত্র জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে একজন উপদেষ্টা যোগাযোগ করেছেন। পাশাপাশি সরকার আদেশ বাস্তবায়নে পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন- প্রধান উপদেষ্টা তো জাতিকে বলেছিলেন যে, দলগুলো যেটুকু মানবেম সেটুকু বাস্তবায়িত হবে। আর বাকিটা তিনি ওয়েবসাইটে দিয়ে জাতিকে জানাবেন। এখন দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, সেটুকু বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো সরকারের। যারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলো সুপারিশে না থাকাতেই এই সংকট তৈরি হয়েছে। সে কারণে এটি সমাধানের দায় কমিশন ও সরকারের। তিনি আরও বলেন, প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য যেভাবেই হোক, দলগুলোকে আস্থায় এনে সরকারকেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের যে অবস্থান তাতে যোগ দিয়েছে তাদের সমমনা দলগুলোও। গত ৭ নভেম্বর বিএনপি সমাবেশ থেকে তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
একই দিনে রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। নির্বাচন (সরকার ঘোষিত) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হতে হবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল আগামী ১১ নভেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছে। দাবি না মানলে সেখান থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথাও বলেছে।
ওদিকে সরকারের দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলার পর জামায়াতের তরফ থেকে আলোচনার জন্য বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বিএনপি তাতে রাজি হয়নি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে বলেছেন- সরকার আলোচনা করতে চাইলে আমরা বসব। অন্য দলগুলোর সঙ্গে আমরা কেন এ নিয়ে আলোচনা করব।
এ ছাড়া সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ। এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, ইতিবাচক কিছু সাড়া পাইনি এখনও, তবে আমরা আশাবাদী। আমাদের চেষ্টাও অব্যাহত আছে। দেখা যাক কী হয়।
এদিকে রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, সরকার তরফ থেকে পর্দার অন্তরালে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। সেই আলোচনায় দুই দলের সম্মতি পেলে বিএনপির দাবি অনুযায়ী গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিন আর জামায়াতের প্রস্তাব অনুযায়ী সংসদের উচ্চপক্ষে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক ভোটের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কোনো মন্তব্য করেননি।
এদিকে এমন পরিস্থিতির জন্য বিএনপি ও জামায়াত সরকারকে ও কমিশনকেই দোষারোপ করছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কমিশনের রিপোর্টটাই একতরফা, যার সঙ্গে জুলাই সনদ যেটি স্বাক্ষর করা হয়েছে, তার মিল নেই। তাহলে ৮-৯ মাস ধরে কসরত করার কী দরকার ছিল। সরকার যা করেছে,
তা দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এক বছর আলোচনা হলো। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য মানুষ শুনেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তো কাজের মিল নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার এখন কীভাবে বলে যে দলগুলোকে সাত দিনের মধ্যে একমত হতে হবে। জবরদস্তি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে, আর আমাদের মানতে হবেÑ তা তো নয়। সরকারের কর্মকাণ্ড ও আচরণে পরিষ্কার যে তারা পক্ষপাত করছে। আমরা আশা করি সরকার পক্ষপাতহীন আচরণ করবে ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেচার গ্রহণ করবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেই সংকটের পথ তৈরি করেছে। দলগুলো যদি এগুলোর সমাধান করতে পারে তাহলে কমিশন কেন হলো, তারা সুপারিশই বা কেনো করল। কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দায়িত্ব সরকারের। আশা করি এখন দলগুলোর দিকে ঠেলে দিবে না।
দীর্ঘ ৯ মাস আলোচনা শেষে গত ১৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব সংবলিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যখন তাদের সুপারিশ হস্তান্তর করে, তখন দলগুলো অভিযোগ করে, সনদ যেভাবে স্বাক্ষর হয়েছে এবং বিভিন্ন সুপারিশে দলগুলোর যে বক্তব্য নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে থাকার কথা, সেগুলো রাখা হয়নি।
বিএনপি বলেছে, সুপারিশ এমন কিছু বিষয় রাখা হয়েছে, যা নিয়ে কমিশনের সভায় আলোচনা হয়নি।
সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয় জুলাই সনদে থাকা সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নে গণভোট কখন হবে, তা নিয়ে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। আর এই সময়ের মধ্যে পরিষদ সেটি করতে না পারলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। এই সুপারিশের সমালোচনা করেছে বিএনপি।
তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। অর্থাৎ, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি নির্বাচনের আগেই হবে। এ নিয়ে সরাসরি বিপরীতমুখী অবস্থানে বিএনপি ও জামায়াত। বিএনপির দাবি- গণভোট হতে হবে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে। আর জামায়াতের দাবি, গণভোট হতে হবে সংসদ নির্বাচনের আগে। দলগুলোর এমন মতবিরোধে উদ্বেগ প্রকাশ করে উপদেষ্টা পরিষদের সভা থেকে গত ৪ নভেম্বর দলগুলোকে ঐকমত্য হওয়ার জন্য এক সপ্তাহের আলটিমেটান দেওয়া হয়, যা শেষ হচ্ছে আজ।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ ‘সরকার এ আদেশ জারি করবে’। এ বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ বা সরকারকে কখনই আইনি আদেশ জারি বা আইনের সমকক্ষ কোনো কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আইন প্রণয়নের কাজ সংসদের। সংসদ না থাকলে রাষ্ট্রপতি সাময়িক সময়ের জন্য অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করতে পারেন।
জুলাই সনদের অধ্যাদেশ প্রধান উপদেষ্টা জারি করতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ওই ক্ষমতা কেবল সংসদ অথবা রাষ্ট্রপতির।
আর ক্ষেত্রবিশেষে যখন সংসদ থাকে না, তখন সাময়িকভাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তো প্রধানমন্ত্রীর মতো। অর্থাৎ, নির্বাহী বিভাগের প্রধান। তিনি তো আইন পাস করতে পারেন না। শাহদীন মালিক আরও বলেন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রথমে গণভোট আয়োজন করা উচিত, এরপর সংসদে বিষয়টি উপস্থাপন করা যায়।