স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদন: একসময় একই দেশের অংশ হলেও ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তা নিয়ে অনলাইন স্ট্রেইট টাইমসে এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক দেবর্ষী দাশগুপ্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এই ভারত। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের এই অবনতি দেশটিকে ইতিমধ্যেই এক কঠিন অবস্থায় ফেলেছে। এখন ভারতের জন্য আরেকটি দুশ্চিন্তার কারণ তৈরি হয়েছে: ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের উষ্ণতা। অতীতের কারণে ইসলামাবাদ ও ঢাকার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ, এমনকি বৈরিতাপূর্ণ।
তিনি আরও লিখেছেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তিক্ত স্মৃতি, বিশেষত শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের সম্পর্কে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের সংঘটিত নৃশংস গণহত্যা ও নারীদের ওপর নির্যাতন ছিল এর মূল কারণ। কিন্তু গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়ে তার সরকারের ‘পাকিস্তানবিরোধী’ অবস্থান শেষ হয়ে গেলে দুই দেশের সম্পর্কে দ্রুত পরিবর্তন আসে।
২৪শে আগস্ট পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন। ১৩ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তা বাংলাদেশে এলেন, যা সম্পর্ক পুনর্গঠনে নতুন গতি দেয়। তিনি বাংলাদেশের জন্য ৬০০টি বৃত্তি ও ৪০ জন আহত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। দুই দেশ একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে আছে কূটনীতিকদের ভিসামুক্ত ভ্রমণ, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ, টেক্সটাইল ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
পাকিস্তান আবারও বাংলাদেশে সরাসরি বিমান চালুর পরিকল্পনা করছে, যা ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ ছিল। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি জাহাজ ভিড়েছে। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সমুদ্র যোগাযোগ শুরু হলো। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মুনিস আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে নতুন সরকার ভারতের দিকে ঝোঁক রাখে না। ফলে পাকিস্তান দ্রুত সুযোগ নিতে চাইছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে শুরু করে। তবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের দায় এখনো দুই দেশের সম্পর্কে বড় বাধা। ঢাকা এখনো পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করে। এখনো পাকিস্তানকে এই ক্ষমা করেনি বাংলাদেশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করছে, পাশাপাশি চীনের দিকেও ঝুঁকছে। মার্চে তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর হয় বেইজিংয়ে। সেখানে বাংলাদেশে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান দেয় চীন। মংলা বন্দর আধুনিকায়নে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে চীন। এতে ভারত উদ্বিগ্ন। কারণ পাকিস্তান-বাংলাদেশ-চীন ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারতের পূর্ব সীমান্তে কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের দাবি, এসব ঐতিহাসিক বিষয় (যুদ্ধাপরাধ, আটকে থাকা সম্পদ, আটকে পড়া পাকিস্তানি সমস্যা) সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে থাকবে না। তারা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। কিন্তু ভারতে অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান ঢাকা প্রশাসন ‘ভারতবিরোধী’। তাদের আশঙ্কা, পাকিস্তানকে বাংলাদেশে গোপনে কাজ করার সুযোগ দেয়া হতে পারে। এছাড়া শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নেয়ায় দুই দেশের সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
ঢাকা অভিযোগ করছে, ভারত থেকে আওয়ামী লীগের ‘বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম’ চলছে। ভারত উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের (বিশেষত হিন্দুদের) পরিস্থিতি নিয়েও। গত এক বছরে ভিসা ও বাণিজ্যে পারস্পরিক বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে এবং চীন থেকে ১২টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ভারত অপেক্ষা করছে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুযোগ আসবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতকে এখনই মানবিক কারণে ভিসা সুবিধা বাড়ানো উচিত এবং একইসঙ্গে কড়া বার্তা দেওয়া উচিত যে, বাংলাদেশের মাটিতে কোনো দেশ ভারতের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। অনুবাদ: মানবজমিন