শিরোনাম
◈ যা ঘটেছিল সেদিন, বর্ণনা দিলেন সেই এইচএসসি পরীক্ষার্থী ◈ পিএসসি সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ ব্লকেড, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি ◈ বাংলাদেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রের ভূমিকা ◈ সরকারি চাকরিতে আসছে বড় পরিবর্তন ◈ বাংলা‌দে‌শে রাজ‌নৈ‌তিক অ‌স্থিরতার ধু‌য়ো তু‌লে আগ‌স্টে সফ‌রে আস‌ছে না ভারতীয় ক্রিকেট দল ◈ একযোগে ১৫ নেতাকে অব্যাহতি দিল ছাত্রদল ◈ পাকিস্তান চীনের ‘জীবন্ত পরীক্ষাগার’, ৮১% সামরিক সরঞ্জাম চীনা: দাবি ভারতের জেনারেল রাহুল সিংয়ের ◈ ক্রোম ব্রাউজারে ভয়ংকর নিরাপত্তাত্রুটির সন্ধান, নিরাপদ থাকতে যা করতে হবে ◈ পাটগ্রামে থানায় হামলার প্রসঙ্গ টেনে জামায়াত আমিরের মন্তব্য: ‘এই পরিস্থিতিতে কী নির্বাচন হবে?’ ◈ পাটগ্রাম থানায় হামলা ও ভাঙচুর: স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাইদুলসহ গ্রেফতার ৪, বিএনপির অস্বীকৃতি

প্রকাশিত : ০৪ জুলাই, ২০২৫, ০৫:৩৫ বিকাল
আপডেট : ০৫ জুলাই, ২০২৫, ১২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আলজাজিরার অনুসন্ধানে বাংলাদেশ-ভারত কিডনি পাচার চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা সম্প্রতি বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রাম নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। চরম দারিদ্র্যের কারণে এই গ্রামের বহু বাসিন্দা নিজেদের কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, যার ফলে গ্রামটি স্থানীয়ভাবে ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করেছেন জয়তী ঠাকুর, আমিনুল ইসলাম মিঠু ও হানান জাফর।

এক পিতার হাহাকার: সফিরুদ্দিনের গল্প

প্রতিবেদনের কেন্দ্রে রয়েছেন ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন। পরিবারের অভাব দূর করতে এবং একটি পাকা বাড়ি তৈরির স্বপ্নে তিনি ২০২৪ সালে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে করা সেই ত্যাগের অর্থ давно ফুরিয়ে গেছে, বাড়ির কাজও থেমে আছে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের তীব্র যন্ত্রণা আর দুর্বল শরীর তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়ংকর সিদ্ধান্তের কথা।

বর্তমানে একটি হিমাগারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করা সফিরুদ্দিন বলেন, "আমি সব করেছি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য।"

দালালচক্রের ভয়ংকর ফাঁদ

সফিরুদ্দিনের মতো মানুষদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে সক্রিয় রয়েছে এক শক্তিশালী দালালচক্র। এই চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট, ভিসা, বিমান টিকিট থেকে শুরু করে হাসপাতালের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেয়। মেডিকেল ভিসায় ভারতে নেওয়া হলেও হাসপাতালের কাগজপত্রে কিডনি দাতাকে ‘রোগীর নিকটাত্মীয়’ হিসেবে দেখানো হয়। এর জন্য তৈরি করা হয় জাল জাতীয় পরিচয়পত্র, ভুয়া জন্মনিবন্ধন এবং এমনকি ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট। যার শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, তার পরিচয় দাতারা কখনোই জানতে পারেন না।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গসংগঠনের একজন সদস্য, জানান যে এই প্রতারণার কৌশল বিশ্বজুড়েই প্রায় একই রকম।

পরিসংখ্যান ও নেপথ্যের কারণ

  • ভয়াবহ চিত্র: ২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ-এর এক গবেষণা অনুসারে, কালাই উপজেলার প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন।

  • প্রধান কারণ: বিক্রেতাদের অধিকাংশই চরম দারিদ্র্য, ঋণের বোঝা, মাদকাসক্তি বা জুয়ায় আসক্তির কারণে এই পথে পা বাড়ান।

  • প্রতারণা: অপারেশনের পর দালালরা দাতাদের পাসপোর্ট বা চিকিৎসার কোনো কাগজপত্র ফেরত দেয় না, যাতে ভবিষ্যতে তারা আইনি পদক্ষেপ নিতে বা চিকিৎসা দাবি করতে না পারেন।

চাহিদা-যোগানের কালোবাজার

এই অবৈধ কিডনির মূল ক্রেতা ভারতের ধনী রোগীরা, যারা দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া এড়াতে চান। ভারতে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ কিডনি রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ের রোগী থাকলেও বৈধ প্রতিস্থাপন হয় মাত্র ১৩ হাজারের কিছু বেশি। এই বিপুল চাহিদা ও যোগানের ফারাকই দালালচক্রকে সক্রিয় রেখেছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, "কিছু মানুষ জেনেবুঝে কিডনি বিক্রি করেন, তবে অনেকেই প্রতারিত হন।"

অনেক সময় বিক্রেতারা প্রতিশ্রুত অর্থও পান না। মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে কিডনি বিক্রি করে হাতে পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন লাখ। প্রতারিত হয়ে তিনি নিজেই দালালচক্রে যোগ দেন, কিন্তু পরে অনুশোচনায় সেই পথ ছাড়েন।

ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা ও হাসপাতালের ভূমিকা

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই চক্র দমনে কোনো সমন্বিত তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা নেই বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর। অনেক সময় ভারতীয় হাসপাতালগুলো ভুয়া কাগজপত্র যাচাইয়ের দাবি করে দায় এড়ায়।

তবে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, অনেক হাসপাতাল জেনেশুনেই এই অবৈধ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত, কারণ "অধিক প্রতিস্থাপন মানে অধিক আয়।" এই বাণিজ্য ভারতের ৭.৬ বিলিয়ন ডলারের মেডিকেল ট্যুরিজম শিল্পের একটি অন্ধকার দিক।

অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা

দালাল মিজানুর রহমানের ভাষ্যমতে, একটি কিডনি প্রতিস্থাপনে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হলেও কিডনি দাতা পান মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। বাকি টাকা দালাল, চিকিৎসক এবং হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।

একটি মানবিক সমাধানের আহ্বান

ভারতের কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ মনে করেন, অঙ্গদানের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর নয়। বরং একটি মানবিক ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রয়োজন, যেখানে দাতাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

প্রতিবেদনটি শেষ হয়েছে সফিরুদ্দিনের হতাশা দিয়ে। তিনি তার অর্ধনির্মিত বাড়ির সামনে বসে ভাবেন, কবে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। তার কণ্ঠের আক্ষেপ যেন পুরো গ্রামের প্রতিধ্বনি: "তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর আমাকে ফেলে চলে গেছে।"


  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়