পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদে উন্নীত করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। মঙ্গলবার (২০ মে) প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফেডারেল ক্যাবিনেট বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। ফিল্ড মার্শাল পদটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ পদ, যা জেনারেল পদের চেয়েও উপরে। এই পদোন্নতির মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই সর্বোচ্চ সামরিক পদে অভিষিক্ত হলেন।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’-এর সফল পরিচালনার মাধ্যমে শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জেনারেল মুনিরকে এই সম্মাননা দেয়া হয়েছে। বৈঠকে জানানো হয়, তিনি সাহসিকতা, দৃঢ় নেতৃত্ব ও কৌশলী পরিকল্পনার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অপারেশন পরিচালনা করে দেশের সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রেখেছেন।
দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিকে এই বিষয়ে আগে থেকেই অবগত করেছিলেন শেহবাজ শরিফ। এদিকে, সরকারি এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন সেনাপ্রধান আসিম মুনির।
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদে অভিষিক্ত হন জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ূব খান। পরে তিনি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর নিজেকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ হিসেবে ঘোষণা করেন। যদিও যুদ্ধটি স্পষ্ট বিজয় এনে দেয়নি, তবুও রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ব সুসংহত করতে তিনি নিজেই নিজেকে এই পদে উন্নীত করেন।
এই পদবী হাতিয়ে নেয়ার পিছনে সামরিক জয়ের চেয়ে রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং সামরিক বাহিনীতে নিজের প্রভাব নিশ্চিত করার অভিলাষই বেশি কাজ করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। অনেক সামরিক ঐতিহাসিকের মতে, এটি ছিল আত্মপ্রচারমূলক এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্ত।
এদিকে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’ মাধ্যমে সেনাপ্রধান আসিম মুনির তার সফল নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছেন।
আসিম মুনির ২০২২ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের ১১তম সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। ২০২৪ সালের নভেম্বরে তার মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়।পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে মুনির দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুক হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়। এতে পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটিতে অপারেশন সিঁদুর পরিচালনা করে ভারত। জবাবে পাকিস্তানও ভারতে পাল্টা হামলা চালায়। ইসলাবাদ দাবি করে, তারা ভারতে হামলা চালিয়ে পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যার মধ্যে তিনটি ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল ছিল।
বিশ্বজুড়ে ফিল্ড মার্শাল উপাধি পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা: ‘ফিল্ড মার্শাল’ হচ্ছে একটি মর্যাদাপূর্ণ সামরিক উপাধি, যা সাধারণত কোনো দেশের সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি সব দেশে নেই, বরং কিছু নির্দিষ্ট দেশেই প্রচলিত রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে শতাধিক ব্যক্তি ইতিহাসে কখনো না কখনো এই পদে আসীন হয়েছেন। উইনস্টন চার্চিল কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে 'ফিল্ড মার্শাল' পদে ছিলেন না, কারণ তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, সৈনিক নয়। তবে, তিনি সম্মানসূচক সামরিক মর্যাদা ও উপাধি পেয়েছিলেন বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অসামান্য নেতৃত্ব ও অবদানের জন্য। ডিউক অব ওয়েলিংটন (নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী), ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমেরি (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে), প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা (সম্মানসূচকভাবে) ‘ফিল্ড মার্শাল’ উপাধি পেয়েছিলেন।
আঠারো এবং উনিশ শতকে জার্মানি এবং কিংডম অব প্রুশিয়ার অনেক জেনারেল ফিল্ড মার্শাল হন। রাশিয়ার ( সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) ‘মার্শাল অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ছিল তাদের সমতুল্য সম্মাননা। মিশর, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, চীন, সিরিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এই পদে ভূষিত হয়েছেন অনেকে।
সার্বিকভাবে বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০০ জনের মতো ব্যক্তি এই পদবী পেয়েছেন। তবে কেউ কেউ 'অনারারি' বা মরণোত্তর হিসেবে এই পদবী পেয়েছেন।
ভারতে এপর্যন্ত দু’জন সামরিক ব্যক্তিত্ব এই মর্যাদাপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের প্রধান স্থপতি। ১৯৭৩ সালে তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ফিল্ড মার্শাল কে. এম. কারিয়াপ্পা স্বাধীন ভারতের প্রথম সেনাপ্রধান। ১৯৮৬ সালে তাকে সম্মানসূচকভাবে ফিল্ড মার্শালের পদ দেয়া হয়।
ভারতে এই উপাধিটি জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে এটি শুধুমাত্র সামরিক কৃতিত্ব ও ঐতিহাসিক অবদানের ভিত্তিতে দেয়া হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতা: সাধারণভাবে বলা চলে, ফিল্ড মার্শাল পদটি যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ কৌশল, জয়, এবং নেতৃত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ দেয়া হয়। তবে কিছু দেশে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা সম্মানসূচক পদ হিসেবেও দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের আইয়ূব খানের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল। সুতরাং এটি সবসময় যুদ্ধজয়ের প্রতীক নয়, বরং অনেক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতেও অপব্যবহৃত হয়েছে।
এই উপাধি আন্তর্জাতিক মানের সম্মাননা কিনা: ফিল্ড মার্শাল পদটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সম্মান নয়, এটি জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সামরিক মর্যাদা। প্রতিটি দেশের নিজস্ব সামরিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ পদ দেয়া হয়। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এই উপাধির মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি প্রদান করে না।
তবে, কিছু ফিল্ড মার্শাল যেমন স্যাম মানেকশ বা ডগলাস ম্যাকআর্থার (মার্কিন সেনা জেনারেল) আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের কৃতিত্বের জন্য তবে এই পদের জন্যে নয়। ফিল্ড মার্শাল পদটি একদিকে যেমন সম্মান ও গৌরবের প্রতীক, তেমনি এটি রাজনৈতিক ফায়দা লুফে নিতে বিতর্কিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উৎস: চ্যানেল২৪