দেশ রুপান্তরের প্রতিবেদন।। মোহাম্মদ এ আরাফাত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। তার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আছে হত্যাসহ একাধিক মামলা। তাকে ধরতে খুঁজছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যান মালয়েশিয়ায়। কিন্তু তার মাল্টিপল ভিসায় সমস্যা থাকায় তিনি আর ভেতরে ঢুকতে পারেননি। পরে অন্য একটি ফ্লাইটে করে চলে যান সিঙ্গাপুর।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের বেলায়ও। তিনি মালয়েশিয়ার ভেতরে যেতে পারেননি। পরে অন্য কোনো দেশে চলে যান। এ দুই নেতার মতোই মালয়েশিয়ায় আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতারা রয়েছেন ভিসা জটিলতায়। তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তাছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অন্য সংগঠনগুলোর নেতাদেরও একই অবস্থ। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দমনপীড়ন চালায়। গুলিতে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ প্রায় হাজারের বেশি প্রাণ হারান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পালানোর পথ খোঁজেন আওয়ামী লীগ নেতারা। জনরোষ থেকে বাঁচতে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরই মধ্যে অনেকে গোপনে দেশের বাইরে পাড়ি দিয়েছেন।
দালাল ও ইমিগ্রেশনকে ‘ম্যানেজ’ করে পালাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার কেউ কেউ ধরাও পড়েছেন। দেশত্যাগের জন্য তারা যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, ফেনী, সিলেট, দিনাজপুরের হিলি ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত ব্যবহার করেছেন। তারপর তারা ভারতের ত্রিপুরা, আগরতলা, কলকাতা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান নেন। কেউ আবার ওই দেশ থেকে মালয়েশিয়াসহ দুবাই, কেউ জার্মানি, কেউবা যুক্তরাজ্যেও চলে গেছেন।
গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পালিয়ে আসা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। যারা বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় এসেছেন তাদের মধ্যে সিঙ্গেল ভিসা বেশি পেয়েছেন। আবার কেউ মাল্টিপল ভিসাও পান। মাল্টিপল ও সিঙ্গেল ভিসার মেয়াদ ছয় মাস। তবে মাল্টিপল ভিসায় একবার মালয়েশিয়া থেকে বের হলেও পুনরায় ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশিদের মধ্যে কারও কারও। বাংলাদেশ থেকে একাধিক নেতার তথ্য মালয়েশিয়া পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী দেশ রূপান্তরকে জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার এক আত্মীয় কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মালয়েশিয়া এসেছেন। তার মাল্টিপল ভিসা ছিল। তিনি কিছুদিন মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ডে যান। সেখান থেকে পুনরায় মালয়েশিয়ায় আসার চেষ্টা করলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আর ঢুকতে দেয়নি। কারণ তার সম্পর্কে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে নেতিবাচক তথ্য ছিল।
তিনি আরও বলেন, অনেক নেতাকর্মী বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তারা মূলত কুয়ালালামপুর, জর্জ টাউন, ইপোহ, কুচিং, জহর বাহরু, কোটা কিনাবালু, শাহ আলম, মালেকা, মিরি, পেতলিং জায়া, পুত্রজায়া, কুয়ালা তেরেঙ্গানু, ইস্কান্দার পুতেরি, সেরেমবানসহ আরও কয়েকটি এলাকায় তারা বসবাস করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে কিছু নেতার বিষয়ে তথ্য এসেছে বলে আমরা জেনেছি। আর এ নেতারা জনসমক্ষে কম আসছেন। তাছাড়া মালয়েশিয়ায় আওয়ামী লীগসহ অন্য সংগঠনের নেতারাও ভিসার সমস্যায় আছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইফুল ইসলাম বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। এর আগে তিনি ভারত ছিলেন। মাসখানেক আগে তিনি এ দেশে এসেছেন। কয়েক মাস আগে কুয়ালালামপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ, ময়মনসিংহ-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিকে কুয়ালালামপুর দেখা গেছে। তাদের মধ্যে কারও কারও ভিসা জটিলতা থাকায় তাদের এখন আর দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়দের ধারণা, তারা অন্য কোনো দেশে চলে যাতে পারেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকরের পতনের পর অনেক নেতা মালয়েশিয়া এসেছেন। তাদের মধ্যে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন নিখিল, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, যুবলীগ নেতা জয়দেব নন্দী রয়েছেন। ভিসা জটিলতায় আরও ভুগছেন মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ কামরুজ্জামান কামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির ও যুবলীগ নেতা জাহিরুল ইসলাম জহির, সহসভাপতি কুতুব উদ্দিন চৌধুরী, ছাত্রলীগ সভাপতি কবিরুজ্জামান জীবন ও সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী তৌহিদ নিজামকে দেখা গেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এ তথ্য জানিয়ে বলেন, তাদের এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
মালয়েশিয়া হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক নেতা মালয়েশিয়া এসেছেন। তাদের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভিসা সমস্যায় পড়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।