বরিশালের বাকেরগঞ্জে গত রোববার একটি কুকুরকে গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একজনকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি আবাসিক ভবনে একটি বিড়ালকে লাথি মেরে হত্যা করেন একজন। এ ঘটনায় অভিযুক্তকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।
এখন প্রশ্ন হলো—প্রাণীকে মেরে ফেলা কি এতই সহজ কিংবা এর শাস্তিও কি এতই কম বা চাইলেই কি যে কেউ কোনো প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে?
বাংলাদেশে প্রাণী নির্যাতন সম্পর্কিত প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো ১৯২০ সালের 'দ্য ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস অ্যাক্ট' বাতিল করে ২০১৯ সালে 'প্রাণী কল্যাণ আইন' প্রণয়ন করা হয়।
এই নতুন আইনের ধারা ৬ ও ৭ অনুযায়ী, কোনো পশুকে বেঁধে রাখা, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা, মারধর করা বা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
ধারা ১৬ অনুযায়ী, কেউ প্রথমবার এমন অপরাধ করলে তার ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
বরিশালে কুকুরকে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা এ অপরাধের মধ্যেই পড়ে। এই নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল ৪ জন। এর মধ্য ৪২ বছর বয়সী শ্রমিক খোকন হাওলাদারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)। অপর তিন অভিযুক্ত কিশোর হওয়ায় মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
বাকেরগঞ্জের এ ঘটনায় জরিমানাও কম, কারাদণ্ড নেই এবং কোনো ফৌজদারি মামলাও হয়নি। কেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অভয়ারণ্য-বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই শাস্তিটা প্রাণী কল্যাণ আইন অনুযায়ী হয়নি, শাস্তি যেটা হয়েছে সেটা সম্ভবত পেনাল কোডে। প্রাণী কল্যাণ আইন যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেটা আসলে শাস্তির জন্য কার্যকর আইন নয়, কারণ এই আইনের রুলস এখনো লেখা হয়নি।'
এ ধরনের ঘটনায় প্রাণী কল্যাণ আইনে মামলা হলে, কারা ও কীভাবে শাস্তি বা বিচার নিশ্চিত করবেন সে বিষয়ে রুবাইয়া আহমেদ বলেন, 'নির্যাতন বা হত্যা যখন হয়, আইন অনুযায়ী সেটার জন্য অনেক প্রটোকল অনুসরণ করতে হয়। মরদেহ নিয়ে ভেটেরিনারি চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, তিনি অটোপসি করবেন, তারপর বলবেন অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে প্রাণীর, তারপর বিচার হবে। এই প্রাণী কল্যাণ আইনটা একেবারে অকার্যকর একটা আইন।'
বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। গত বছরের নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন এলাকায় অন্তত ১০টি কুকুর-বিড়ালকে বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে ৩টি কুকুর ও একটি বিড়ালে মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায়ও মামলার পর শাস্তি পান অভিযুক্তরা।
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করে হাতেগোনা এমন অল্প কিছু সংস্থা ও গণমাধ্যমের চাপের কারণেই কিছু ঘটনার বিচার হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথ্য-প্রমাণ এমনকি অপরাধীর স্বীকারোক্তি, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য থাকা স্বত্ত্বেও অপরাধী শাস্তি পায় না। প্রচলিত আইন থাকলেও তা প্রয়োগের খুব একটা নজির নেই। কারণ কী?
এমন প্রশ্নের জবাবে রুবাইয়া বলেন, 'আইন থাকলেও তা কার্যকরে কোনো পৃথক ইউনিট বা বাহিনী নেই। ফলে অনেক প্রাণী নির্যাতনের মামলা বিচার ছাড়াই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই আইনটাকে কার্যকর করতে হবে, বিষয়টি নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। খুব শিগগির এটা হবে বলে মনে হয় না। এখন প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতার যত মামলা হচ্ছে, সব পেনাল কোড অনুযায়ী শাস্তি হচ্ছে।'
এছাড়া অনেকেই পোষা বা পথকুকুরকে প্রাণী হিসেবেই বিবেচনা করে না, ফলে এমন ঘটনাগুলো সমাজে গুরুত্ব পায় না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাণী নির্যাতনকে মানুষের ওপর সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন এমনকি হত্যার সমতুল্য হিসেবেও দেখা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে 'একটি কুকুর মারা গেছে তো এমন কি'—এমন সংস্কৃতি প্রচলিত। আইন, শাস্তি বা বিচারের চেয়েও বড় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই প্রাণীর প্রতি নৃশংসতা বন্ধ করা সম্ভব।
রুবাইয়া আহমেদ বলেন, 'প্রাণী কল্যাণ আইন দ্বারা এখন পর্যন্ত কোনো আশাব্যঞ্জক কিছু না হলেও, যতদিন কার্যকর আইন না হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত বা পেনাল কোডের মাধ্যমে যতটুকু শাস্তি দেওয়া সম্ভব, সেটা হলেও প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতা কমে আসবে বলে আশা করি।' উৎস: ডেইলি স্টার।