পিঠে ও কোমরে ব্যথাকে অনেকেই সাধারণ পেশির টান বা ক্লান্তি ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু এই ব্যথা হতে পারে কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মারাত্মক সমস্যার প্রাথমিক ইঙ্গিত। চিকিৎসকেরা বলছেন, কিডনির রোগকে 'নীরব ঘাতক' বলা হয়, কারণ এর লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে এতটাই সাধারণ থাকে যে তা সহজে শনাক্ত করা যায় না। যখন লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়, ততক্ষণে কিডনির অনেকটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সুমন (ছদ্মনাম) বেশ কিছুদিন ধরেই পিঠের নিচের অংশে এবং কোমরের পাশে একটানা ব্যথায় ভুগছিলেন। অফিসের কাজের চাপ এবং দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফল ভেবে তিনি ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে সাময়িকভাবে উপশম পেতেন। কিন্তু ব্যথা যখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায় এবং এর সাথে শরীর দুর্বল লাগতে শুরু করে, তখন তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। রক্ত ও মূত্র পরীক্ষার পর জানা যায়, তার কিডনির কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সুমনের মতো অনেকেই এমন ভুল করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ পিঠের ব্যথা এবং কিডনির ব্যথার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা খেয়াল করা জরুরি। সাধারণ মাসল পেইন বা পেশির ব্যথা সাধারণত নড়াচড়া করলে বাড়ে বা কমে, কিন্তু কিডনির সমস্যাজনিত ব্যথা গভীর এবং একটানা অনুভূত হয়।
কেন কিডনি এত গুরুত্বপূর্ণ?
শরীর সুস্থ রাখার জন্য কিডনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর মূল কাজ হলো:
শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল পদার্থ ছেঁকে মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেওয়া।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা।
রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মতো খনিজের ভারসাম্য বজায় রাখা।
লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়ক 'এরিথ্রোপোয়েটিন' নামক হরমোন নিঃসরণ করা।
কিডনি বিগড়ে গেলে এর প্রভাব পড়ে শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গে। সমস্যা হলো, কিডনির কর্মক্ষমতা প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ কমে না আসা পর্যন্ত সাধারণত স্পষ্ট কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এজন্য নিয়মিত রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা না করলে রোগ ধরা পড়তে অনেক দেরি হয়ে যায়।
বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ শাফি বলেন, "পিঠ বা কোমরের ব্যথা হলেই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। তবে যদি ব্যথাটি শিরদাঁড়ার নিচের দিকে বা পাঁজরের ঠিক নিচে, কোমরের দুই পাশে হয় এবং ব্যথানাশকেও না কমে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এর সাথে যদি প্রস্রাবের সমস্যা বা শরীর ফোলাভাবের মতো লক্ষণ থাকে, তবে তা কিডনি রোগের জোরালো ইঙ্গিত দেয়।"
কোন কোন লক্ষণে বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া দরকার?
১. পিঠ ও কোমরে গভীর ব্যথা: শিরদাঁড়ার নিচের দিকে, পাঁজরের নিচে বা কোমরের এক বা দুই পাশে তীব্র ও একটানা ব্যথা কিডনির সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এই ব্যথা তলপেটেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিডনিতে পাথর, সংক্রমণ (ইনফেকশন), বা মূত্রনালিতে বাধা থাকলে এ ধরনের ব্যথা দেখা দেয়।
২. প্রস্রাবের ধরনে পরিবর্তন: কিডনির সমস্যার এটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, বিশেষ করে রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
প্রস্রাবের রং গাঢ়, ঘোলাটে বা ফেনা ফেনা হওয়া।
প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া (হেমাচুরিয়া)।
প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া বা ব্যথা অনুভব করা।
৩. শরীর ফুলে যাওয়া (ইডিমা): কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ ও পানি বের হতে পারে না। এই অতিরিক্ত তরল শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে পা, গোড়ালি, হাত ও চোখের চারপাশে জমে ফুলে যায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের চারপাশ ফোলা থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
৪. শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা: কিডনির কার্যক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেলে ফুসফুসে পানি জমতে পারে (পালমোনারি ইডিমা)। এর ফলে শ্বাসকষ্ট হয়। এছাড়া রক্তস্বল্পতার কারণেও শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, যা থেকে শ্বাসকষ্ট এবং বুকে চাপ অনুভূত হতে পারে।
৫. খাদ্যে অরুচি ও বমি ভাব: কিডনি অকেজো হয়ে পড়লে রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিনের মতো বর্জ্য পদার্থ জমতে থাকে। এই অবস্থাকে ইউরেমিয়া বলা হয়। এর ফলে মুখে ধাতব স্বাদ, ক্ষুধামান্দ্য, ওজন কমে যাওয়া এবং বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
৬. চরম ক্লান্তি ও দুর্বলতা: সুস্থ কিডনি এরিথ্রোপোয়েটিন (EPO) নামক হরমোন তৈরি করে, যা লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই হরমোনের উৎপাদন কমে যায়, ফলে রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) দেখা দেয়। রক্তস্বল্পতার কারণে শরীর ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, যা থেকে চরম ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং মনোযোগের অভাব দেখা দেয়।
৭. ত্বকের সমস্যা: রক্তে বর্জ্য পদার্থ জমে যাওয়ার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে এবং অস্বাভাবিক চুলকানি হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
উপরোক্ত যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ যদি আপনার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে দেখা দেয়, তবে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে, তাদের বছরে অন্তত একবার কিডনি পরীক্ষা (রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও ইউরিন আর/এম/ই) করানো উচিত। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচানো সম্ভব।
সূত্র : নিউজ24, বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে।