সন্তানহীনতার জন্য প্রায়শই শুধু নারীকে দায়ী করা হলেও, বাস্তবতা হলো এর জন্য পুরুষও সমানভাবে দায়ী হতে পারেন। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ জরুরি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. মোসাম্মাত রাশিদা বেগম।
ডা. রাশিদা বেগমের মতে, "কোনো দম্পতি যদি এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া নিয়মিত সহবাস করার পরও সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন, তবে তাকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। এই সমস্যা নারী বা পুরুষ উভয়েরই হতে পারে।"
পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা মূলত তার বীর্যে থাকা শুক্রাণুর সংখ্যা, গুণমান, এবং কার্যকারিতার ওপর নির্ভরশীল। নিম্নলিখিত কারণগুলো পুরুষের বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী হতে পারে:
১. শুক্রাণু সংক্রান্ত সমস্যা:
এজোস্পার্মিয়া (Azoospermia): বীর্যে শুক্রাণুর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।
অলিগোস্পার্মিয়া (Oligospermia): বীর্যে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম পরিমাণে শুক্রাণু থাকা।
অ্যাসথেনোস্পার্মিয়া (Asthenospermia): শুক্রাণুর গতিশীলতা বা চলার ক্ষমতা কম থাকা।
টেরাটোস্পার্মিয়া (Teratozoospermia): শুক্রাণুর অস্বাভাবিক আকৃতি।
২. শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ:
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: টেস্টোস্টেরনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় হরমোনের ঘাটতি।
অণ্ডকোষের সমস্যা: জন্মগত ত্রুটি, সংক্রমণ (যেমন মাম্পস), আঘাত বা ভ্যারিকোসেল (অণ্ডকোষের শিরা ফুলে যাওয়া)।
শুক্রাণু নির্গমনে বাধা: শুক্রনালী বন্ধ থাকা বা জন্মগতভাবে তৈরি না হওয়া।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগ।
যৌন অক্ষমতা বা সহবাসে অসুবিধা।
৩. জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত কারণ:
ধূমপান ও অ্যালকোহল: এগুলো শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান নষ্ট করে।
পরিবেশ দূষণ: রাসায়নিক, কীটনাশক এবং দূষিত খাবারের প্রভাব।
উচ্চ তাপমাত্রা: গরম পরিবেশে একটানা কাজ করা অণ্ডকোষের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
তেজস্ক্রিয়তা: আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন রশ্মি ও রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসা।
৪. চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণ:
কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
ক্যানসারের চিকিৎসা, যেমন—কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি।
ডা. রাশিদা বেগম জানান, পুরুষের বন্ধ্যাত্বের সঠিক কারণ নির্ণয় করে কার্যকর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে, যেমন—সম্পূর্ণ শুক্রাণুহীন অবস্থায় চিকিৎসা বেশ জটিল হতে পারে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ধূমপান ও অ্যালকোহল পুরোপুরি পরিহার করা। রাসায়নিক ও কীটনাশকমুক্ত অর্গানিক খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা।
কর্মপরিবেশ পরিবর্তন: যারা উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে কাজ করেন, তাদের ঠান্ডা পরিবেশে কাজ করার সুযোগ খোঁজা উচিত।
নিয়ন্ত্রিত জীবন: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি:
হরমোন থেরাপি: হরমোনের ঘাটতি থাকলে ইনজেকশন বা ওষুধের মাধ্যমে তার চিকিৎসা করা হয়।
সার্জারি: শুক্রাণু নির্গমনের পথে কোনো বাধা বা ভ্যারিকোসেল থাকলে সার্জারির মাধ্যমে তার সমাধান করা হয়।
সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি (Assisted Reproductive Technology - ART):
আইইউআই (IUI): শুক্রাণুর সংখ্যা কিছুটা কম কিন্তু গতিশীলতা ভালো থাকলে এই পদ্ধতিতে জরায়ুতে সরাসরি শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়।
আইভিএফ (IVF): এই পদ্ধতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে শরীরের বাইরে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয় এবং পরে তা জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
ইকসি (ICSI): যখন শুক্রাণুর সংখ্যা বা গুণমান খুব খারাপ থাকে, তখন একটি মাত্র সুস্থ শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুর ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিষিক্ত করা হয়। এটি বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি সফল পদ্ধতি।
শুক্রাণু সংরক্ষণ (Sperm Freezing): ক্যানসারের চিকিৎসা (কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি) শুরু করার আগে শুক্রাণু সংরক্ষণ করে রাখা যায়, যা পরবর্তীতে সন্তান গ্রহণের জন্য ব্যবহার করা যায়।
ডা. রাশিদা বেগম বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন, “পুরুষের বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি লুকিয়ে রাখা বা অবহেলা করার মতো নয়। এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা। নারীর পাশাপাশি পুরুষের বন্ধ্যাত্ব সম্পর্কেও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক সময়ে নির্ভুল চিকিৎসা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।” উৎস: নিউজ24