আপনি যদি ঘরে বসে টাকা ছাপাতে শুরু করেন, তবে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। কারণ, একটি দেশের মুদ্রা ছাপানোর একচ্ছত্র অধিকার কেবল তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু যদি কোনো একটি দেশ তার প্রয়োজনে প্রায় অবাধে টাকা ছাপাতে পারে এবং সেই টাকা পুরো বিশ্ব ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, তখন কী হবে? ঠিক এই কাজটিই করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর সেই মুদ্রার নাম—ইউএস ডলার। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে精心ভাবে সাজানো একটি বৈশ্বয়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার परिणाम।
এই প্রবন্ধে আমরা ডলারের এই আধিপত্যের পেছনের ইতিহাস, কার্যকারিতা, প্রভাব এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আপনার দেওয়া তথ্যের মতোই, মানব সভ্যতার শুরুতে ছিল পণ্য বিনিময় প্রথা বা বাটার সিস্টেম (Barter System)। এর মূল সমস্যা ছিল চাহিদার অসামঞ্জস্যতা (Double Coincidence of Wants)। এই সংকট কাটাতেই মানুষ সোনা, রুপা, লবণ বা কড়ির মতো পণ্যকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে, যা কমোডিটি মানি (Commodity Money) নামে পরিচিত।
ধাতব মুদ্রার প্রচলনের পর শাসকরা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন: মানুষ ধাতুর চেয়েও শাসকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বা সিলমোহরকে বেশি বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় কাগজের মুদ্রা, যা শুরুতে ছিল নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার বিপরীতে একটি রশিদ বা প্রমিসরি নোট (Promissory Note)। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় স্বর্ণমান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (Gold Standard)।
"ফিয়াট" (Fiat) একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ "এটি সম্পন্ন হোক" (Let it be done)। ফিয়াট মুদ্রা (Fiat Currency) হলো এমন এক ধরনের মুদ্রা যার নিজস্ব কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই (যেমনটা সোনার আছে), বরং এর মূল্য নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রীয় আদেশ এবং জনগণের বিশ্বাসের উপর।
আপনি যখন ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ টাকা ঋণ নেন, ব্যাংক কম্পিউটারে একটি সংখ্যা টাইপ করে সেই অর্থ "তৈরি" করে। এই প্রক্রিয়াটি ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং (Fractional Reserve Banking) নামে পরিচিত। ব্যাংকগুলো আমানতের একটি ক্ষুদ্র অংশ (রিজার্ভ) নিজেদের কাছে রেখে বাকি অর্থ ঋণ হিসেবে প্রদান করে, যা বারবার হাতবদল হয়ে অর্থনীতিতে নতুন অর্থ তৈরি করে। এই ব্যবস্থা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখলেও, লাগামহীন ঋণপ্রদান মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
সূত্র: Federal Reserve Bank of St. Louis. "Fractional Reserve Banking."
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস শহরে ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা একত্রিত হন। এই সম্মেলনেই ব্রেটন উডস চুক্তি (Bretton Woods Agreement) স্বাক্ষরিত হয়, যা ডলারকে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করে।
চুক্তির মূল বিষয়গুলো ছিল:
১. ডলার-স্বর্ণ সংযোগ: মার্কিন ডলারকে সোনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয়, যেকোনো দেশ তাদের ডলার ফিরিয়ে দিয়ে সমমূল্যের সোনা ফেরত নিতে পারবে।
২. অন্যান্য মুদ্রা-ডলার সংযোগ: বিশ্বের অন্যান্য প্রধান মুদ্রাগুলোর মান ডলারের সঙ্গে স্থির করা হয়।
এই চুক্তির ফলে ইউএস ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ কারেন্সি (Reserve Currency) বা সংরক্ষিত মুদ্রার মর্যাদা পায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংক (World Bank)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ব্যবস্থার অধীনে তৈরি হয়, যাদের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত।
সূত্র: International Monetary Fund (IMF). "The End of the Bretton Woods System (1972–81)."
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ বিপুল খরচের কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাপে পড়ে। অনেক দেশ তাদের ডলারের বিপরীতে সোনা ফেরত চাইতে শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের ভাণ্ডার দ্রুত কমতে থাকে।
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একটি আকস্মিক ঘোষণা দেন, যা ইতিহাসে "নিক্সন শক" (Nixon Shock) নামে পরিচিত। তিনি ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এর ফলে পুরো বিশ্ব গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে বেরিয়ে এসে একটি সম্পূর্ণ ফিয়াট মুদ্রা ব্যবস্থায় প্রবেশ করে।
ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র এরপর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। তারা সৌদি আরবের সঙ্গে একটি চুক্তি করে, যার মূল ভিত্তি ছিল:
যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে সামরিক নিরাপত্তা ও অস্ত্র সরবরাহ করবে।
বিনিময়ে সৌদি আরব তেল বিক্রি করবে শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে।
পরে ওপেক (OPEC) ভুক্ত সব দেশ এই নীতি অনুসরণ করে। এটিই পেট্রোডলার সিস্টেম (Petrodollar System) নামে পরিচিত। যেহেতু তেল বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য একটি অপরিহার্য পণ্য, তাই তেল কিনতে সব দেশকে ডলার অর্জন করতে হয়। এটি ডলারের জন্য একটি চিরস্থায়ী বৈশ্বিক চাহিদা তৈরি করে, যা সোনার সংযোগ ছাড়াই ডলারের মূল্য ধরে রেখেছে।
সূত্র: Council on Foreign Relations. "The Enduring Power of the Petrodollar."
ডলারের এই একচ্ছত্র আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে, যা অন্য কোনো দেশের নেই।
১. অতিরিক্ত সুবিধা (Exorbitant Privilege): ফ্রান্সের এক অর্থমন্ত্রী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এর অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে যত খুশি ডলার ছাপাতে পারে। যেহেতু বিশ্বজুড়ে ডলারের চাহিদা রয়েছে, তাই এই অতিরিক্ত ডলার বিশ্ব অর্থনীতি শোষণ করে নেয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মুদ্রাস্ফীতির চাপ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম হয়। তারা বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি (আমদানি > রপ্তানি) নিয়েও টিকে থাকতে পারে।
২. অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও SWIFT সিস্টেম: বিশ্বের প্রায় সব আন্তর্জাতিক লেনদেন সুইফট (SWIFT) নামক একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যা বেলজিয়ামভিত্তিক হলেও মার্কিন প্রভাবাধীন। যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাইলে তাকে এই সিস্টেম থেকে বের করে দিতে পারে। ইরান, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে একঘরে করে ফেলার এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
৩. ঋণের ফাঁদ: বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মূলত ডলারে ঋণ দেওয়া হয়। সেই ঋণ পরিশোধ করতে হলেও তাদের ডলার আয় করতে হয়। কোনো কারণে তাদের স্থানীয় মুদ্রার মান কমে গেলে, ডলারের বিপরীতে ঋণের বোঝা বহুগুণ বেড়ে যায়। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার জাতীয় ঋণ ছিল জিডিপির ১১৯%, যা যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও কম। কিন্তু তাদের ঋণ ছিল ডলারে, যা পরিশোধ করতে না পারায় তারা দেউলিয়া হয়ে যায়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ডলারেই, যা তারা নিজেরাই ছাপতে পারে।
সূত্র: The Economist. "What is the SWIFT payment system?"
ডলারের এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
ব্রিক্স (BRICS): ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিক্স ডলারের বিকল্প একটি লেনদেন ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। তারা নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়াচ্ছে এবং একটি সাধারণ মুদ্রা চালুর কথাও ভাবছে।
চীনের ইউয়ান: চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ইউয়ানে ঋণ দিচ্ছে এবং বাণিজ্যে এর ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। তারা ডিজিটাল ইউয়ান চালু করেছে, যা ডলারের বিকল্প হতে পারে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি: বিটকয়েনের মতো বিকেন্দ্রীভূত ডিজিটাল মুদ্রাগুলো কোনো রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। অনেকেই একে ডলারভিত্তিক ব্যবস্থার একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন। তবে এর অস্থিরতা, আইনি জটিলতা এবং বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
টাকা আদতে একটি বিশ্বাসের খেলা। আমরা ২০ টাকার একটি নোটকে মূল্যবান মনে করি কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে অন্যরাও একে মূল্যবান মনে করবে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে হয় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে।
ডলারের শাসন যুক্তরাষ্ট্রকে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু এটি বৈশ্বিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাও তৈরি করেছে। ডি-ডলারাইজেশনের প্রচেষ্টা বাড়লেও নিকট ভবিষ্যতে ডলারকে প্রতিস্থাপন করা কঠিন। তবে বিশ্ব ধীরে ধীরে একটি মাল্টি-পোলার (Multi-polar) মুদ্রা ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে ডলারের পাশাপাশি ইউয়ান, ইউরো বা অন্য কোনো মুদ্রার গুরুত্ব বাড়বে।
এই জটিল অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য টিকে থাকার সেরা উপায়।