ঘুম মানুষের শরীরের জন্য এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীরকে নতুনভাবে কাজ করার শক্তি জোগায় ঘুম। কিন্তু যদি এমন হয় যে, রাতের পর্যাপ্ত ঘুমের পরেও সকালে আপনি ক্লান্ত বোধ করছেন? কিংবা দিনের বেলায় কাজের মাঝে, আড্ডায় বা সামান্য বিশ্রামের সুযোগ পেলেই চোখে ঘুম নেমে আসছে? এই মাত্রাতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব এবং সার্বক্ষণিক ক্লান্তি মোটেও স্বাভাবিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের অভাব।
কেন এই অতিরিক্ত ঘুম?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে শরীরে ভিটামিন ‘বি’, বিশেষ করে ভিটামিন বি-১২ (B12) এর ঘাটতি। এই ভিটামিনের অভাবে শরীরে ক্লান্তি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যার ফলে মস্তিষ্ক ও শরীর বারবার বিশ্রামের জন্য সংকেত পাঠায় এবং অতিরিক্ত ঘুম পায়। এছাড়া, এই ঘাটতির ফলে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে, যা ক্লান্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ভিটামিন বি-১২ এর গুরুত্ব:
ভিটামিন বি-১২ আমাদের শরীরের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এর প্রধান কাজগুলো হলো:
লোহিত রক্তকণিকা তৈরি: এই ভিটামিন শরীরের লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Cells) এবং ডিএনএ (DNA) উৎপাদনে সরাসরি সাহায্য করে। লোহিত রক্তকণিকা সারা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এর ঘাটতি হলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, ফলে শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা: আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে (Nervous System) সুস্থ ও সচল রাখতে ভিটামিন বি-১২ এর ভূমিকা অপরিসীম। এর অভাবে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দুর্বলতা, ভারসাম্যহীনতা এমনকি স্মৃতিশক্তি হ্রাসের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
যখন শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি-১২ থাকে না, তখন শরীর সঠিকভাবে শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। ফলে সামান্য কাজেই হাঁপিয়ে ওঠা, সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
যেহেতু ভিটামিন বি-১২ মূলত প্রাণীজ খাবার থেকে পাওয়া যায়, তাই যারা নিরামিষাশী (Vegetarians) বা ভেগান (Vegans), তাদের মধ্যে এই ভিটামিনের অভাব হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া, বয়স্ক ব্যক্তি এবং হজমের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও শরীর খাদ্য থেকে এই ভিটামিন শোষণ করতে পারে না, ফলে ঘাটতি দেখা দেয়।
কীভাবে বুঝবেন ঘাটতি হয়েছে?
অতিরিক্ত ঘুম ও ক্লান্তি ছাড়াও ভিটামিন বি-১২ এর অভাবের আরও কিছু লক্ষণ হলো:
ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা বা অবশভাব।
মুখে বা জিহ্বায় ঘা হওয়া।
মনোযোগ দিতে অসুবিধা এবং স্মৃতিশক্তির সমস্যা।
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসা।
প্রতিকার ও সমাধান:
বিশেষজ্ঞরা বার বার মনে করিয়ে দেন যে, আমাদের শরীর নিজে থেকে ভিটামিন বি-১২ তৈরি করতে পারে না। এটি অবশ্যই খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। তাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
ভিটামিন বি-১২ এর প্রধান খাদ্য উৎস:
মাছ ও সামুদ্রিক খাবার: বিশেষ করে স্যামন, টুনা ইত্যাদি মাছে প্রচুর পরিমাণে বি-১২ পাওয়া যায়।
মাংস: যেমন রেড মিট (গরুর মাংস, খাসির মাংস), মুরগির মাংস ইত্যাদি।
ডিম: ডিমের কুসুমে ভিটামিন বি-১২ থাকে।
দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, পনির ইত্যাদি ভিটামিন বি-১২ এর চমৎকার উৎস।
ফর্টিফায়েড খাবার: কিছু সিরিয়াল (Cereals) এবং সয়া মিল্কে বাইরে থেকে ভিটামিন বি-১২ যোগ করা হয়, যা নিরামিষাশীদের জন্য ভালো বিকল্প হতে পারে।
শেষ কথা:
যদি আপনি দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত ক্লান্তি ও ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, তবে বিষয়টিকে অবহেলা করবেন না। একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই শরীরে ভিটামিন বি-১২ এর মাত্রা জানা সম্ভব। ঘাটতি থাকলে চিকিৎসক আপনাকে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিতে পারেন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন।
সূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদন।