শিরোনাম
◈ প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনডিএ: কেন, কিভাবে, কতটা যৌক্তিক? ◈ ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল অর্থনীতির অংশীদার হতে চায় বাংলাদেশ: আশিক চৌধুরী ◈ যশোরে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে  বিএনপির ৬ নেতা, কর্মীকে বহিঃস্কার ◈ জুয়ার আসর থেকে ইউনিয়ন জামাতের সভাপতি ও ইউপি সদস্যসহ গ্রেপ্তার ১৪ ◈ ৬০০০ রানের মাইলফলকে জো রুট ◈ জুলাই অভ্যুত্থানের গেজেট থেকে ৮ শহীদের নাম বাদ, তালিকা প্রকাশ ◈ এনসিপির ইশতেহার ঘোষণা, ছাত্রদলের সমাবেশে নির্বাচনমুখী বক্তব্য ◈ ১০ লাখ টাকার বেশি আমানত ও সঞ্চয়পত্রে রিটার্ন বাধ্যতামূলক ◈ জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠান: এবার ৮ জোড়া ট্রেন ভাড়া করল সরকার ◈ কুমিল্লায় ইউপি সদস্যকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা

প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট, ২০২৫, ০৩:০২ রাত
আপডেট : ০৪ আগস্ট, ২০২৫, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনডিএ: কেন, কিভাবে, কতটা যৌক্তিক?

বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন।। শুল্ক হার কমানোর আলোচনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গোপনীয়তার চুক্তি বা ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তি জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা দেবে কিনা এবং শুল্ক কমাতে আদৌ এটি জরুরি ছিল কিনা- এমন প্রশ্ন ব্যবসায়ীসহ দেশের সব মহলে। এদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তির মূল নিয়ামক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তাকে দেখছে। তবে চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ পরিপন্থি কোনও কিছু নেই বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

চুক্তির বিষয়টিকে নন-পেপার না করে সরাসরি এনডিএ করায় এটি একটি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে, বলছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বাজারজাতে শুল্ক পরিশোধে সুবিধা পেতে এখন বাংলাদেশ যদি লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এত কিছুর পরেও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে এনডিএ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলির সুযোগ নেই।

জানা গেছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সংবেদনশীল তথ্য ব্লক করতে দ্বিপাক্ষিক বা এর অধিক পক্ষ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে "এনডিএ" করা যেতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনগণের সুরক্ষার জন্য সরকার কিছু তথ্য গোপন রাখতে পারে। এনডিএ এমন একটি আইনি চুক্তি বা চুক্তির অংশ যেখানে গোপনীয় উপাদান, জ্ঞান বা তথ্যের রূপরেখা থাকে। চুক্তির পক্ষরা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বিষয়গুলো একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়, আবার এর পথও সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। যেমন, ব্যাংক আর গ্রাহকের গোপনীয়তা চুক্তি এনডিএ’র উদাহরণ, যা প্রায়ই পক্ষগুলোর মধ্যে লিখিত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে না।

সূত্র জানায়, একটি অপ্রকাশ চুক্তি (এনডিএ) একতরফা, দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক হতে পারে।

একপাক্ষিক বা একমুখী এনডিএ দুটি পক্ষের মধ্যে হয়, যেখানে শুধু একটি পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করার প্রত্যাশা করে এবং কোনও কারণে তথ্যটি আরও প্রকাশ থেকে সুরক্ষিত রাখতে বাধ্য করে। যেমন, পেটেন্ট আইন বা বাণিজ্য গোপনীয়তার জন্য আইনি সুরক্ষা বজায় রাখা; কোনও বড় ঘোষণার জন্য একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করার আগে তথ্য প্রকাশ সীমিত করা; অথবা কেবল এটি নিশ্চিত করা যে কোনও গ্রহণকারী পক্ষ প্রকাশকারী পক্ষকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তথ্য ব্যবহার বা প্রকাশ করতে পারবে না ।

আবার একটি দ্বিপাক্ষিক বা দ্বিমুখী এনডিএ এমন দুটি পক্ষের মধ্যে হয় যেখানে দুপক্ষই একে অপরের কাছে এমন তথ্য প্রকাশের প্রত্যাশা করে, যা আরও প্রকাশ থেকে রক্ষা করতে প্রতিটি পক্ষই চায়। এই ধরনের এনডিএ যৌথ উদ্যোগ বা একীভূতকরণ বিবেচনা করে এমন ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রচলিত।

অন্যদিকে, বহুপাক্ষিক এনডিএতে তিন বা ততধিক দল থাকে যেখানে কমপক্ষে একটি দল অন্য দলের কাছে এমন তথ্য প্রকাশ করার প্রত্যাশা করে এবং যেখানে তথ্যটি আরও প্রকাশ থেকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হয়। যেমন, তিনটি দলের স্বাক্ষরিত একটি একক বহুদলীয় এনডিএ; যারা প্রত্যেকে অন্য দুটি দলের কাছে তথ্য প্রকাশ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তিনটি আলাদা দ্বিপাক্ষিক এনডিএ’র পরিবর্তে এ ধরনের এনডিএ করতে পারে।

সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনডিএ থাকায় বাংলাদেশ এখনও সম্পাদিত চুক্তির অনেক বিষয়ে স্পষ্ট নয়। তবে এখন গোপনীয়তা বজায় রাখার আর যৌক্তিকতা নেই। মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে যা দিতে সম্মত হয়েছে, তার বেশির ভাগই পরের নির্বাচিত সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

জানা গেছে, এই চুক্তিতে বাংলাদেশ যেসব বিষয়ে ছাড় দিয়েছে, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা আছে, কিছু কিছু বিষয়ে অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপার আছে, যেগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত।

সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতির বিরোধী। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের উচ্চ শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের সামগ্রিক রফতানির ওপরও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারেরও সংকোচনের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটি হলে তা বাংলাদেশের রফতানির জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ধরনের 'নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট' (এনডিএ) সই করেছে, তা দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এর আগে কোনও পার্টনার (অন্য কোনও দেশ) কোনোদিন এনডিএ ডকুমেন্ট দেয়নি। তিনি বলেন, ‘একটি বিষয়কে নন-পেপার না করে সরাসরি এনডিএ করা হয়েছে। যার ফলে এটি এখন একটি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনও লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।’

সিপিডির আরেক ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনডিএ থাকায় আমরা এখনও চুক্তির অনেক বিষয়ে পরিষ্কার জানি না। তবে এখন গোপনীয়তা বজায় রাখার আর কোনও যৌক্তিক কারণ নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে আমরা যা দিতে সম্মত হয়েছি, তার অধিকাংশই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা যেসব বিষয়ে ছাড় দিয়েছি, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা আছে, কিছু কিছু বিষয়ে অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপার আছে, যেগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক ছাড় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের বেশ বড় আকারে শুল্ক আদায় হ্রাসের বিষয়ও যুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি কেনাকাটার শর্ত পূরণের জন্য বাড়তি খরচও বহন করতে হবে। এই সবকিছুরই অর্থনৈতিক অভিঘাত আছে।

ড. মোস্তাফিজ আরও বলেন, শুল্ক কমানোর জন্য কি কি ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা দেশটিকে যা যা দিয়েছি, তা অর্থনৈতিক মূল্যমান ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার নিরিখে বিচার করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব কামাল আহমেদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে এনডিএ’র কথা বলা হচ্ছে সেটা আসলে কী? বাণিজ্য আলোচনার সময়ে দরকষাকষির কোনও তথ্য প্রকাশ না করার শর্ত, নাকি কোনও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে কোনও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি? দরকষাকষির তথ্য আলোচনার সময়ে গোপন রাখার শর্ত একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কোনও সুযোগ নিতে না পারে। কিন্তু বিষয়টি যদি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোনও বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি শর্ত হয়, যেমনটি ছিল ভারত-বাংলাদেশ ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, তাহলে সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। সুতরাং নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট কী বিষয়ে সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে কামাল আহমেদ জানিয়েছেন, আমি মনে করি এটি খুবই স্বাভাবিক। যেকোনও ইস্যুতে এনডিএ হতে পারে। কারণ আলাপ-আলোচনার সময় কোনও তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে আলোচনা বা দরকষাকষির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা উঠিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ আদৌ কোনও চুক্তি করেছে কিনা। যদি করে থাকে তাহলে তা সম্পাদনের পরে সবার সামনে উপস্থাপন করবে কিনা। হয়তো করবে বলে আমার বিশ্বাস। এতে দেশের কোনও তথ্য ব্লক করে দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জনের কোনও সুযোগ নেই। বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরে দুই দেশের (যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ) যৌথ বিবৃতি অবশ্যই আসবে। সব বিষয়ই জানানো হবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, দুঃখজনক হলেও চুক্তির বিষয়গুলো আগেই প্রচার হয়ে গিয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনও বিষয় নেই। অনেকে বলছেন, আমরা গোপনীয়তার চুক্তি করেছি। আসলে একটি চুক্তিতে কিছু বিষয় আন্তর্জাতিক বিধিতে নির্দিষ্টভাবে গোপন থাকে। সেটি চুক্তিকারী উভয় দেশের জন্য, যেন অন্য কোনও দেশ বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ না করতে পারে।

তিনি বলেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে বিষয়টি নিশ্চিত করে চুক্তিগুলো করছে সেটা হচ্ছে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। চুক্তির মূল নিয়ামক হিসেবে তারা নিজস্ব নিরাপত্তাকে দেখছে। ফলে আলোচনার একটি গোপনীয় শর্ত আছে।

‘তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার কোনও বিষয় থাকলে আমরা সে চুক্তিতে যাবো না নিশ্চয়ই। নিজস্ব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি হবে, তাহলে এমন বাণিজ্য চুক্তি করে কোনও লাভ হবে না। আর যা পরোক্ষভাবে দেশের স্বার্থবিরোধী হতে পারে, আমরা আলোচনার মাধ্যমে সেটি থেকে বেরিয়ে এসেছি।‘

শেখ বশিরউদ্দিন বলেন,  চুক্তির জন্য আমরা বোয়িং কেনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি আগ্রহ ছিল সেটা কিন্তু নয়। কারণ তাদের এসব অর্ডার সরবরাহ করতে অনেক বছর লেগে যাবে। মূলত জ্বালানি পণ্য ও কৃষি পণ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার বিষয়ে আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়