অনুজ দেব বাপু, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে গত কয়েক মাসে বেড়ে চলা চালের বাজারে অস্থিরতা কাটেনি। পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা কমলেও খুচরাতে সেরকম কোনো প্রভাব পড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমা, বোরো মৌসুমে ভালো ফলন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণসহ সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিলেও সুফল মিলছে না। এদিকে আড়তদারদের অভিযোগ, ধান ও চাল মজুদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী।
চাক্তাই ও পাহাড়তলী পাইকারি বাজারসহ নগরীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে গত দেড়-দুই মাস ধরেই চালের দাম বাড়তি। সর্বশেষ জুলাই মাসে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে। এমনকি চালের ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে দাম বেড়েছে। অন্যদিকে, বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকে ট্রাকে চাল আসছে পাইকারি বাজার চাক্তাই ও পাহাড়তলীসহ বিভিন্ন বাজারে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে এবং এক সপ্তাহ পর থেকে বিভিন্ন চালের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
বিশেষ করে খুচরা পর্যায়ে চিকন চালের দাম বস্তাপ্রতি প্রায় ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে। মোটা চালের দাম বেড়েছে ১০০-১২০ টাকা। খুচরা বাজারে মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকা বলা হলেও বাস্তবে অধিকাংশ স্থানে তা ৬০-৬৫ টাকার নিচে মিলছে না। মাঝারি মানের মিনিকেট, পাইজাম, বিআর-২৮, নাজিরশাইল প্রজাতির চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০- ৭০ টাকা দরে। ৭৫-৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে অন্য সব চাল। ভালো মানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাল ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে নাজিরশাইল, বিআর-২৮, পাইজাম, স্বর্ণা, জিরাশাইল, গুটি স্বর্ণা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪-৭ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, গত কয়েকদিনে ৮০-১২০ টাকার মতো কমেছে চালের দাম। অনিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার কারণে ধান ও চালের দাম বাড়ছে। মিল মালিকরা ও করপোরেট গ্রুপ এক্ষেত্রে দায়ী। মিল থেকে বলা হচ্ছে ধান সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না, ধানের সংকট এবং ধানের দাম বাড়তি। স্বর্ণা, পাইজামের সিশন শেষ, তাই সংকট থাকায় এগুলোর দাম বাড়াটা যৌক্তিক। তবে মিনিকেট, বাসমতি, জিরা চালগুলোর দাম বাড়াটা অযৌক্তিক।
চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম আমাদেরসময়ডটকমকে বলেন, আমদানি জটিলতায় সময়মতো চাল পৌঁছায়নি। যা এসেছে তাও চাহিদার তুলনায় কম। তবে সরকার আজ সোমবার (১৮ আগস্ট) থেকে ডিউটি ক্লিয়ার করেছে। ফলে চালের সংকট কমে আসার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। ভারত থেকেও আগামী দুয়েকদিনে চাল আসবে। তাই বাজারে দাম কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দীন বলেন, এবার বেরো মৌসুমে চালের ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের কারণে আমাদের দেশে এর সুফল পাওয়া যায় না। গত সপ্তাহে সবাই যাতে এলসি করতে পারে সে বিষয়ে একটি নির্দেশনাও এসেছে। ফলে চালের দাম এ সপ্তাহে কিছুটা কমে এসেছে। বিভিন্ন প্রকার চালের বস্তায় ৮০-১০০ টাকা আবার কোনোটিতে ১০০-১২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। তবে খুচরা বাজারে দামে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে একটু হয়তো সময় লাগবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, এলসির অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তো চাল আমদানি করেন না। এর মানে ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে, তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেই সরবরাহে সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে ফলনও এবার ভালো। সংকট কেন হবে। চালের দামের উপর যেহেতু মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে, সেহেতু সরকারকে চালের দামের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। নইলে এর ফলে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্রমতে, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে চালের দাম বেড়েছে। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ছিল ৪০ শতাংশ, যা জুলাই মাসে বেড়ে হয়েছে ৫১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ১৭ আগস্ট রোববার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মান্থলি ইকোনমিক আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতিতে মাঝারি চাল ও মোটা চালের অবদান ছিল যথাক্রমে ২৪ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে মাঝারি ও মোটা চালের দামে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। আর চিকন চালে গত ১২ মাস ধরে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি রয়েছে। জুলাই মাসে তিন ধরনের চালের মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশে।