মাছুম বিল্লাহ: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেছেন, ‘প্লাস্টিক আমাদের দেশের সুন্দর পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। প্লাস্টিক একাধারে মাটি, পানি ও সমুদ্র দূষিত করছে। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাতাসও দূষিত হচ্ছে, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না।’
রোববার সকালে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (সিদ্ধেশ্বরী, রমনা), ঢাকায় বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ও বারসিক এর যৌথ আয়োজনে ‘প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত এবং আইনগত প্রেক্ষাপট’ বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
এ আয়োজনে সহ-আয়োজক হিসেবে ছিলো পরিবেশ উদ্যোগ, বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (বিএনসিএ) ও সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)।
উপমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবেনা। ব্যক্তি পর্যায়ে প্লাস্টিক রিসাইকেল সম্ভব না হলেও আমরা চাইলে প্লাস্টিক রিফিউজ এবং রিইউজ করতে পারি। এতে করে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে। দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে সবার অবস্থান থেকে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সরকারকে প্লাস্টিক দূষণের জন্য নির্ধারিত আইন প্রয়োগে সহযোগিতা করতে হবে।’
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান। গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী এবং সকল অতিথিদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ রোধের দাবিতে একটি মানববন্ধন করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধে ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান বলেন, ‘প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, দূষিত বায়ু জীববৈচিত্র্যের উপর বীরুপ প্রভাব ফেলছে। মাটি এবং জলাধারগুলোতে জমে থাকা বিষাক্ত প্লাস্টিক খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে এবং বিভিন্ন স্তরের জীবের খাদ্য চক্রে মিশে যাচ্ছে। তাই উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। এর সাথে উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন এমপি বলেন, ‘প্লাস্টিক আমাদের নিত্যদিনের অতি প্রয়োজনীয় সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাইলেই খুব সহজে এর ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারবো না। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের পূর্বে এর বিকল্প উদ্ভাবন করতে হবে এবং সবাইকে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘সকল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। প্লাস্টিক রোধে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রয়োজন। বাংলাদেশে পাটের ব্যাগ উদ্ভাবন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাবে প্রচার প্রসার হয়নি। প্লাস্টিক দূষণ রোধে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে পাঠ্যপুস্তক এর পাশাপাশি মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে।’
বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, ‘মানব সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার একই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণও।
বিএনসিএ এর সদ্যস সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের মাছ কমে গেছে। বিএফডিসি এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মেরিন এ ৪৭৫ প্রজাতির মাছ সনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ফেসিয়ালিস ঘাটে ১৮ থেকে ২০ প্রজাতির বেশি মাছ দেখা যায় না স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচতে হলে বিদ্যমান পরিবেশন বাস্তবায়ন করা জরুরি।’
সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি এফেয়ার (সিএলপিএ) এর সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, ‘পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।’
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) এর সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, ‘প্লাস্টিক নিয়ে আমাদের সচেতনতা কম। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক সচেতন। প্লাস্টিক এমন একটি পণ্য যেটি বারবার রিসাইক্লিং করা যায়। আমাদের উচিত আমাদের নিজেদের সম্পদকে ব্যবহার করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। প্লাস্টিককে বন্ধ করা সম্ভব নয় বরং আমাদের এই প্লাস্টিককে পুনরায় ব্যবহার করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’
গোলটেবিল বৈঠকে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত প্রভাব মোকাবেলায় বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-
১। পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা (বায়োডিগ্রেডেবল) ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করা এবং এসব ব্যাগ ও ঠোঙ্গা ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
২। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রচলন করা।
৩। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর পলিথিন এবং প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যেন বিদ্যালয় থেকেই শিশুরা সচেতন হতে পারে।
৪। পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল আমদানি বন্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫। বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত পলি-প্রপাইলিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬। উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে।
৭। উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে এবং এই বিষয়ে আইন প্রনয়ন করতে হবে।
৮। পরিবেশ অধিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। সম্পাদনা: শামসুল হক বসুনিয়া
এসএইচবি/এনএইচ