বলিউডের কোনো অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প অনেক সময় পর্দার গল্পকেও হার মানায়; বিশাল জেঠওয়া তেমনই একজন। চলতি বছর নীরজ ঘেওনের ‘হোমবাউন্ড’ সিনেমা দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় থাকা এই অভিনেতার এক বস্তি থেকে অস্কার পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চলতি বছর ভারত থেকে অস্কারে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ‘হোমবাউন্ড’কে; গত সপ্তাহে ওটিটিতে মুক্তির পর থেকে বাংলাদেশি দর্শকেরাও মজেছেন এই সিনেমায়। তবে অনেকেই জানেন না পর্দায় দুর্দান্ত অভিনয় করা বিশালের গল্প।
বস্তির দিনগুলো
১৯৯৪ সালের ৬ জুলাই এক গুজরাটি পরিবারে বিশালের জন্ম হয়। বাবা নরেশ জেঠওয়া ও মা প্রীতি জেঠওয়া। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা বিশাল ছোট থেকে অভাবের মধ্যে বড় হয়েছেন। জীবিকার খোঁজে বিশালের বাবা একসময় মুম্বাই পাড়ি দেন। বাণিজ্য নগরীতে এসে অকূলপাথারে পড়েছিল জেঠওয়া পরিবার। ছোটখাটো কাজকর্ম করে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পরিবারের অন্ন সংস্থান করার জন্য মুম্বাইয়ের সড়কে ডাব বিক্রি করা শুরু করেন নরেশ। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল ঘিঞ্জি বস্তিতে। ছোট থেকে অভাব নিত্যসঙ্গী হলেও লেখাপড়ার জন্য ছেলেকে উৎসাহ দিতে নরেশ ও প্রীতি।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশাল বলেন, ‘বস্তিতে বেড়ে ওঠা প্রতিটি শিশুর মতো আমিও আকাশে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হতাম। বিদেশে ভ্রমণের স্বপ্ন ছিল আমার। মনে আছে, যখন লন্ডনে থাকা কোনো এক চাচা আমাদের দেখতে আসতেন, আমরা ভাবতাম, “কত বড় মানুষ”।’
টিভি থেকে শুরু
বিশাল ২০১৩ সালে টিভি শো ‘মহারাণা প্রতাপ’ দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন। এই শোয়ের সময় প্রথমবার উড়োজাহাজে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে তিনি সেই ফ্লাইট মিস করেন! এরপর তাঁকে দেখা যায় ‘ভারত কা বীর পুত্র’, ‘ডিয়া অউর বাতি হাম’, ‘পেশওয়া বাজিরাও’ ইত্যাদি সিরিয়ালে। কম মানুষই জানে, তিনি ‘সা রে গা মা পা’ রিয়েলিটি শোতে ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার হিসেবেও ছিলেন।
‘মর্দানি ২’ দিয়ে ভাগ্যবদল
পর্দায় তাঁর দৃষ্টির নিষ্ঠুর শীতলতায় চমকে উঠেছিল সিনেপ্রেমীরা। রানি মুখার্জির সঙ্গে সমানতালে সাবলীলভাবে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন ছোটপর্দা থেকে উঠে আসা এই অভিনেতা। ‘মর্দানি ২’-এর খলচরিত্র কিশোর অপরাধী ‘সানি’র ভূমিকায় তাঁর হাড় হিম করা উপস্থিতি কাঁপিয়ে দিয়েছিল দর্শকের বুক। আলোচিত এই সিনেমার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
অভিনেতা বিশাল জানান, ‘মর্দানি ২’ ছবির সময় প্রযোজক আদিত্য চোপড়ার দেওয়া একটি উপদেশ আজও মেনে চলেন তিনি। ‘তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলেন নিজেকে পরিচালকের কাছে পুরোপুরি সঁপে দিতে। সেই মন্ত্র আমি এখনো মেনে চলি। “হোমবাউন্ড”-এও নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছিলাম। এর বাইরে আমার কী করা উচিত, তা আমার জানা ছিল না। ছবিটা করার সময় একটা কথাই আমার মনে হয়েছিল যে নীরজ স্যার এই ছবির জন্য সময়, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা—সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছেন, আমাকে তার যথাযোগ্য সম্মান দিতে হবে।’
‘হোমবাউন্ড’ দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি
চলতি বছর কানে ‘হোমাবাউন্ড’ সিনেমার প্রিমিয়ারের পরেই আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান বিশাল। কান উৎসবে প্রদর্শনের পর ৯ মিনিট ধরে স্ট্যান্ডিং ওবেশন পায় সিনেমাটি। এরপর ভারত সিনেমাটিকে অস্কারে পাঠিয়েছে, অস্কার মনোনয়নের চূড়ান্ত তালিকায় সিনেমাটি জায়গা পাবে কি না, সেটা জানা যাবে সামনের মাসে।
উত্তর প্রদেশের এক গ্রামকে ঘিরে বোনা হয়েছে ‘হোমবাউন্ড’-এর কাহিনি। দুই তরুণের নিখাদ বন্ধুত্ব, পুলিশে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন আর এর ভেতর দিয়ে সমাজের জাতপাত ও ধর্মীয় বৈষম্যের মতো বিষয় উঠে এসেছে। ছবিতে ‘চন্দন কুমার’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশাল। এই সিনেমা বদলে দিয়েছে বিশালের দর্শনও। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে ইংরেজি বলতে পারলেই কেউ উচ্চশ্রেণির হয়ে যায়। আমি ঝরঝরে ইংরেজি বলতে পারতাম না, তাই হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। কিন্তু এই ছবির পর আমি নিজেকে গ্রহণ করতে শিখেছি।’
স্বপ্নপূরণ
শৈশবে বস্তিতে দাঁড়িয়ে যে কিশোর উড়োজাহাজে চড়ার স্বপ্ন দেখতেন, তিনিই আজ ‘হোমবাউন্ড’ সিনেমা নিয়ে ঘুরেছেন পাঁচটি শহর। ‘আমি ১৫ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আছি, কিন্তু বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া হয়নি। (তবে) গত এক বছরে আমি এ ছবির জন্য লন্ডন, সুইজারল্যান্ড, প্যারিস, কান, দুবাই ও টরন্টোতে ঘুরেছি। এই সিনেমা আমার জীবনে অনেক কিছু নিয়ে এসেছে।’
তবে বিশালের জন্য সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত ছিল মায়ের সঙ্গে বিদেশভ্রমণ। তিনি বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে সফর আমার জন্য অমূল্য স্মৃতি। অন্যদের জন্য এটি সাধারণ হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য মায়ের সঙ্গে বিজনেস ক্লাসে যাত্রা এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। আমি এই মুহূর্ত নিয়ে গর্বিত।’
সূত্র: প্রথম আলো