শিরোনাম
◈ মির্জা ফখরুলের কণ্ঠ নকল করে অসত্য ভিডিও প্রচার: বিএনপির বিবৃতি ◈ বাহরাইনে একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক: কাতারের ভিসা পুনরায় চালুর অনুরোধ পররাষ্ট্র উপদেষ্টার ◈ পুঁজিবাজারে মূলধন কমেছে ১১ হাজার ১০ কোটি টাকা ◈ জাতীয় নির্বাচনে মাঠে থাকবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য ◈ জাকির নায়েকের সফর প্রসঙ্গে দিল্লির মন্তব্যের জবাব দিল ঢাকা ◈ নভেম্বরে ছুটি নেই সরকারি চাকরিজীবীদের, ডিসেম্বরে মিলবে টানা অবকাশ ◈ ২০২৬ সালে রোজা শুরু কবে? ◈ রেস্তোরা থেকে খামার, সবখানে অভিযান! অবৈধ অভিবাসীদের বের করে দিচ্ছে কানাডা (ভিডিও) ◈ সকল রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মধ্যে একতা থাকতে হবে, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন ঐক্য ধরে রাখতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা  ◈ দেশের বাজারে আবার বাড়ল স্বর্ণের দাম!

প্রকাশিত : ০১ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:৩৮ দুপুর
আপডেট : ০২ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

টাকা দিলেই ‘অ্যাওয়ার্ড’: শোবিজে সম্মান নয়, চলছে বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য

যুগান্তর প্রতিবেদন: ‘অ্যাওয়ার্ড’-সম্মান, মর্যাদা ও কাজের স্বীকৃতির প্রতীক। বিভিন্ন অঙ্গনের সফলদের সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতেই অ্যাওয়ার্ড তথা পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শোবিজ অঙ্গনে এর বর্তমান চিত্র যেন তার উল্টো। শোবিজে এখন অ্যাওয়ার্ড আর শিল্পীর সম্মানে বা কাজের স্বীকৃতির জন্য দেওয়া হয় না, পুরোটাই এখন বাণিজ্য! এখনকার অ্যাওয়ার্ড মানে টিকিট, স্পন্সর ও টাকার খেলা। প্রকৃত মেধাবী কিংবা সফলরা থেকে যায় হিসাবের বাইরে, অখ্যাত কিংবা অযোগ্যরা অর্থের বিনিময়ে ‘অ্যাওয়ার্ড’ হাতে নিয়ে পোজ দেন ক্যামেরার সামনে। এ নিয়ে শোবিজ অঙ্গনে নিত্য চলে বিতর্ক, ওঠে সমালোচনার ঝড়। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।

‘পুরস্কার ও সম্মাননা’ নিয়ে অনেকেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের বিশেষ ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া হয়। আর সম্মাননা হচ্ছে সম্মানসূচক পদক। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির দীর্ঘ সাফল্যের জন্য যেমন সম্মাননা দেওয়া যায়, তেমনি এ ধরনের আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যও সম্মাননা দেওয়া যেতে পারে। বড় কথা হচ্ছে, এ সম্মাননা কারা দিচ্ছেন এ বিষয়টিতে যেমন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি যিনি এটি পাচ্ছেন তারও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু সে বিষয়টিও যাচাই করা প্রয়োজন। অন্যথায় এ সম্মাননার ঔজ্জ্বল্য বা ভার কমে যায়।

দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় পুরস্কার ও পদক প্রথা স্বাধীনতার পর থেকেই প্রচলিত। সর্বাধিক স্বীকৃত নাগরিক পুরস্কার হলো একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, যা প্রতিবছর দেওয়া হয়। কখনো কখনো এসব পুরস্কার মরণোত্তর হিসাবেও প্রদান করা হয়। এ ছাড়া রয়েছে আরও বেশকিছু খেতাব ও পুরস্কার। এতে একজন ব্যক্তির দীর্ঘ সফলতাকে মূল্যায়ন করা হয়। 

রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে এ সম্মাননা প্রদান শুরু হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন থেকেও। তবে সম্মাননার জায়গায় ‘অ্যাওয়ার্ড’ শব্দের বহুল ব্যবহার এটিকে দিনকে দিন বিতর্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে অ্যাওয়ার্ড আয়োজন। বছরের অধিকাংশ সময় নানা ইস্যুতেই আয়োজিত হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান। আর দেওয়া হচ্ছে অ্যাওয়ার্ড। কারা দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, আর কাদের দিচ্ছে- ঘুরেফিরে এসব প্রশ্ন উঠছে। অনেক সংগঠন, এমনকি অচেনা, নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠানও বছরে দু-একবার এ রকম আয়োজন করে ন্যূনতম যাচাই-বাছাই ছাড়াই অখ্যাত অযোগ্যদের হাতে তুলে দিচ্ছে পুরস্কার।

শুধু তাই নয়, অর্থ দিলেই মিলছে এসব অ্যাওয়ার্ড, এমন অভিযোগও উঠেছে। অ্যাওয়ার্ডের জন্য শিল্পীদের নামের তালিকাভুক্তির আগেই ফোনে বা সরাসরি যোগাযোগ করে ‘স্পন্সরশিপ’ বা ‘প্যাকেজ’ নিলে পুরস্কার নিশ্চিত করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। যোগ্যরা পুরস্কার কিংবা অ্যাওয়ার্ড পাবেন, এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু অনেক আয়োজনে অযোগ্য, অপরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত, বিতর্কিতদের হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বইতেও দেখা গেছে। নামি-বেনামি অনেক সংগঠনের এসব আয়োজনে দেখা গেছে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। শোবিজ অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ নেই, এমন কথিত মডেল তথা অভিনেত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ‘শ্রেষ্ঠ শিল্পী’র পুরস্কার। এসব অনুষ্ঠানে সেই কথিত মডেল-অভিনেত্রীরা নিজেদের প্রদর্শন করতেই খোলামেলা পোশাকে আসেন। যা খুবই দৃষ্টিকটু।

অন্যদিকে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম। যাকে-তাকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। এমনও হয়েছে, যারা পুরস্কার পাচ্ছেন, তারা নিজেরাও জানেন না ঠিক কোন কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হলো! সম্মান দেখানোর এ বাণিজ্যিক প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই গুরুত্ব হারাচ্ছে ‘অ্যাওয়ার্ড’। এটি যেন হয়ে গেছে বাজারে বিক্রীত মাল। টাকা দিলেই মিলছে। তাই তো অর্থবিত্তের অধিকারী সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরাও পাচ্ছেন এমন ‘অ্যাওয়ার্ড’। 

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত অধিকাংশ অ্যাওয়ার্ডের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিল্পীদের অনেকেই এ ধরনের ভুঁইফোড় অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। শিল্পীদের অভিযোগ মানহীন এসব আয়োজন শুধু শিল্পীর সম্মান ক্ষুণ্ন করছে না, বরং আসল শিল্পী ও সাধারণ দর্শকের মধ্যকার আস্থাও নষ্ট করছে। পুরস্কার প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের শুরুতে লম্বা তালিকা করে প্রচারণা চালায়, এরপর টিকিট বিক্রি, কর্পোরেট চাঁদা, লাইভ সম্প্রচারের নামে বাণিজ্যিক ডিল, সব মিলিয়ে আয়োজন হয়ে ওঠে নিছক লাভের প্রকল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন অ্যাওয়ার্ড পাওয়া কঠিন নয়, কঠিন হলো অ্যাওয়ার্ডের মান বজায় রাখা। ‘পুরস্কার পাওয়া’ আর ‘পুরস্কৃত হওয়া’-এ দুই শব্দের অর্থ আলাদা।

কিন্তু বর্তমান অ্যাওয়ার্ড সংস্কৃতিতে পার্থক্যটা পুরো মুছে গেছে। সম্মানজনক জাতীয় পুরস্কার (যদিও এটার সিলেকশন নিয়েও রয়েছে বিতর্ক) ও দীর্ঘদিনের স্বনামধন্য কিছু পুরস্কার ছাড় বাকি অধিকাংশ প্ল্যাটফর্মে এখন বিচার প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। অনেক সময় আয়োজক কমিটি নিজেরাই মনোনয়ন চূড়ান্ত করে, আবার অনেক অনুষ্ঠানে স্পন্সরের প্রতিনিধি বা আয়োজকদের ব্যক্তিগত সম্পর্কই পুরস্কার নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, ‘অনেকেই এসব পুরস্কার নেওয়ার জন্য ৩০ থেকে ৫০ হাজার, কখনো ১ লাখ টাকা দেন! তাদের লোভের কারণেই এমন অনুষ্ঠান হয়। কিসের ভিত্তিতে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, আর যে নিচ্ছেন সে কিসের ভিত্তিতে পুরস্কার নিচ্ছেন কেউই তা জানে না।’ এ অভিনেতা আরও বলেন, ‘এ সময়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বাণিজ্য চলছে। আমাকেও অফার করা হয়েছিল একাধিকবার, কিন্তু যাইনি। যখন ফিল করব যাওয়া উচিত, তখন দেখা যাবে। আমার যাওয়া নিয়ে কিছুই যায় আসে না, কিন্তু তারপরও বলব, অ্যাওয়ার্ড-বাণিজ্য চলছে।’

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ও অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, ‘তথাকথিত এসব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান কেন করে, কারা করে, তা জানা নেই। সিনেমা হচ্ছে না, শিল্পীদের মাথা নষ্ট। সেখানে এত অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান! আমি আমাদের সমিতির শিল্পীদের সতর্ক করেছি, আপনি যে অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, তার মান কেমন, তা আগে নিশ্চিত হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, অনেকেই যে ধরনের ড্রেসআপ-গেটআপে এসব অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, এ ধরনের পোশাক ও সাজসজ্জাকে শিল্পী হিসাবে আমরা সমর্থন করি না। আমাদের কালচার অনুযায়ী কতটুকু কী করা উচিত, তা জানা থাকা দরকার। শোবিজে কাজ করলেও আমাদের পোশাক সম্পর্কে রুচিবোধ থাকতে হবে।’ 

চিত্রনায়িকা দিলারা হানিফ পূর্ণিমা বলেন, 'আমি প্রায়ই এ ধরনের (অ্যাওয়ার্ড) অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। কিন্তু কারা আয়োজন করছে বা কাদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে আমি তাদের কাউকেই চিনি না। আমাকে যখন ডাকেন তখন আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কেন অ্যাওয়ার্ড দেবেন?’ তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেন না। বলেন, এমনি নাকি দেবে। আবার অনেকেই বলেন, আমাকে উপস্থাপনাও করতে। কিন্তু যেখানে আমি কাউকেই চিনি না, সেখানে আমি কী করে যাব? তাই যাই না।'

নাট্যভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি বলেন, ‘আমাকে প্রায়ই অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার জন্য বলে, কিন্তু আরেকটি কথা বলা হয়, আমাকে নাকি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে হবে। তার মানে বিষয়টি কী দাঁড়াল, পারফর্ম করলেই তারা অ্যাওয়ার্ড দেবেন! এটা তো আমি চাই না। আমার কাজের জন্য যদি কেউ সম্মাননা দেয় তা আমি নেব। কিন্তু পারফর্ম করে কিছু নিতে হবে তা তো আমার কাজের মূল্যায়ন হলো না। তাই আমি এসব আয়োজনে খুব বেশি যাই না।’

বিতর্কিত এসব আয়োজন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বেশ ক্ষোভ রয়েছে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় চলে এ নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা। তাদের দাবি, এসব অ্যাওয়ার্ড বা সম্মাননা কারা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য কী, এসব খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আর যারা সঠিক পন্থায় এসব আয়োজন করবেন, তাদের ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে হবে ব্যক্তির অতীত কর্মকাণ্ড, সামাজিক অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা। যেহেতু বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকবিহীন এমন আয়োজন অসম্ভব, তাই পৃষ্ঠপোষক এবং ওই সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে একটি প্রকৃতিগত পার্থক্য নিয়ে আসতে হবে। যাতে দুপক্ষের সম্মান ঠিক রেখে সম্মাননা দেওয়া যায়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বসহকারে যাচাই-বাছাই করতে হবে ব্যক্তির সামাজিক কর্মকাণ্ড। আর যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো সংস্থা বা সংগঠন থেকে সম্মাননা দিতে যাচ্ছেন, তাদের সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে সম্মান দেখানোর চেয়ে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে অ্যাওয়ার্ড বিক্রেতা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক অ্যাওয়ার্ড সংস্কৃতি না থামলে শিল্পীরা প্রকৃত মানদণ্ডে মূল্যায়িত না হয়ে ‘পেইড আইকন’ হিসাবে পরিচিত হয়ে পড়বেন। এর জন্য প্রয়োজন পুরস্কার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করা, বিচারিক প্রক্রিয়া প্রকাশ এবং নিয়মিত কাজের ওপর ভিত্তি করে সম্মান দেওয়া। অন্যথায় পুরস্কার নয়, ‘অ্যাওয়ার্ড মার্কেট’ হিসাবেই স্মরণীয় হয়ে উঠবে দেশের শোবিজে বর্তমান সম্মাননা আয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়