শিরোনাম
◈ সহিংসতার ঢেউয়ে কেঁপে ওঠা বাংলাদেশের সামনে নতুন পথ রচনার সুযোগ  ◈ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল ◈ ইং‌লিশ লি‌গে অ‌নেক ক‌ষ্টে জিত‌লো আর্সেনাল ◈ ঢাকার উদ্বেগ: বাংলাদেশে ‘ভারতবিরোধী স্রোত’, দিল্লির গভীর উদ্বেগ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কি সহিংসতায় ব্যাহত হবে? ◈ ১০ জনের সেভিয়ার বিরু‌দ্ধে রিয়াল মাদ্রিদের জয়, রোনালদোর রেকর্ড ছুঁলেন এমবাপ্পে ◈ হালান্ডের কীর্তির দিনে ও‌য়েস্ট হ‌্যা‌মের বিরু‌দ্ধে ম‌্যান‌চেস্টার সি‌টির জয় ◈ সাবেক ১০ সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আজ ◈ তারেক রহমানকে বহনকারী ফ্লাইট থেকে মধ্যরাতে দুই কেবিন ক্রু প্রত্যাহার করলো বিমান ◈ নির্বাচন ও গণভোট ঘিরে সরব কূটনীতিকরা: কঠোর নিরাপত্তার বার্তা সরকারের ◈ ভালুকায় হিন্দু যুবককে পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যা, কী ঘটেছিল সেখানে

প্রকাশিত : ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১০:০১ দুপুর
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:১২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাজেট বাড়লেও শিক্ষার মানে অগ্রগতি নেই, কাঠামোগত দুর্বলতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় ধরা হয় ২২৩ ডলার অর্থাৎ ২৭ হাজার ২০৬ টাকা। তবে এ বরাদ্দের সিংহভাগই চলে যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ এবং বেতন-ভাতায়। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, গবেষণা ও পাঠ্যক্রম সংস্কারে তুলনামূলকভাবে খুব কম বিনিয়োগ করা হচ্ছে। প্রতি বছর বরাদ্দকৃত বাজেট খরচ হওয়ার পরেও শিক্ষাব্যবস্থায় মানের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে না বলে মত শিক্ষাবিদসহ অনেকের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানভেদে দেশের স্কুলগুলোতে এখনও যোগ্য শিক্ষক, নতুন পাঠ্যপুস্তক এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার মতো মৌলিক সুযোগের অভাব রয়েছে। এর ফলে শ্রেণিকক্ষ প্রায় মুখস্থবিদ্যার জায়গা হিসেবে পরিণত হয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাশাপাশি শিক্ষার প্রকৃত মান নিয়ে প্রায়ই উঠছে প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বরাদ্দকৃত বাজেট দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত নয় এবং পরিকল্পিত ও সুষমভাবে বণ্টণ হচ্ছে না। স্কুল-কলেজগুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না; প্রতিষ্ঠানগুলোতে মনিটরিং, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। স্থান ও প্রতিষ্ঠানভেদে ফ্যাসিলিটিজ বা সুযোগ-সুবিধার তারতম্যসহ আরও বিভিন্ন বিষয়কেই শিক্ষার মান না বাড়ার নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। তাছাড়াও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়েও শিক্ষার প্রতি সরকারে উদাসীনতা ও শিক্ষা কমিশন গঠন না করাকেও শিক্ষার মান না বাড়ার জন্য দায়ী করছেন তারা।

“প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো কেমন, জবাবদিহিতা আছে কিনা, তারা ঠিকঠাক ক্লাসে যান কিনা, পড়ান কিনা, তাদের মনিটরিং আছে কিনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা কেমন, এসব শর্ত বিবেচনায় আসলে শিক্ষার মান আমাদের দেশে ভাল হচ্ছে না। যদি ভালই হতো তাহলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ অনেক অফিসারই তাদের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়িয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াতেন। রাজধানী বা অন্যান্য শহরের মানুষেরাও তাদের সন্তাদেরকে সরকারি স্কুলে না দিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে দিচ্ছেন।” - অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

চলতি বছরের গত জুন মাসে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেন। নতুন বাজেটে শিক্ষাখাতের জন্য ৯৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটি আগের বছরের সংশোধিত ৮৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকার তুলনায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। কিন্তু এটি জাতীয় বাজেটের ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা দেশের মোট অর্থনীতির তুলনায় ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

যদিও জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)-এর প্রস্তাবনা অনুসারে, এই পরিমাণ ৪ থেকে ৬ শতাংশ হওয়ার কথা। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশ তার অর্থনীতির প্রায় ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে এটিকে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে শিক্ষাব্যবস্থার মানে তেমন কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে অর্থনীতির তুলনায় সবচেয়ে কম ব্যয় করা দশ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সাথে তুলনা করলেও এ ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান এ খাতে ব্যয় করে ৭ শতাংশের বেশি। ভারত ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এমনকি আফগানিস্তান তাদের সংকটাপন্ন অবস্থাতেও ব্যয় করছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং পাকিস্তান ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। 

“আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বৈশ্বিক বিবেচনায় খুব একটা ভাল অবস্থানে নেই। এর একটি কারণ, আমরা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাল বা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছি না, যারা কারিকুলাম নিজেরা ভাল বুঝে এবং শিক্ষার্থীদের বুঝাতে পারেন। আর নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকের নিজেদেরই ঘাটতি থাকে, তাহলে তারা অন্যের ঘাটতি কীভাবে পূরণ করবে?” -অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা— মূল ভিত্তিই দুর্বল থেকে যাচ্ছে। 

ইউনেস্কোর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১০–১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫১ শতাংশই বয়স-উপযোগী সাধারণ অনুচ্ছেদ ঠিকভাবে পড়তে ও বুঝতে পারে না। অর্থাৎ সাক্ষরতার হার উচ্চ দেখালেও, বাস্তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানেও একই অবস্থা। অনেক শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস মিস করেন। এ ধরনের অনুপস্থিতির পেছনে বড় কারণ— শিক্ষকরা সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা বা ব্যক্তিগত কোচিং দেওয়া।

এসব কারণে সরকারি স্কুলের শিক্ষার মান কমছে, আর অভিভাবকরা সন্তানদের টিউশন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। কোচিং সেন্টারগুলো সেখান থেকে আয় করছে বড় অঙ্কের অর্থ, ফলে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে। এ পরিস্থিতি শহর ও গ্রামের শিক্ষার মানের পার্থক্য আরও বাড়াচ্ছে, ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে।

“৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা। কিন্তু সরকার সেটিতে গুরত্ব দেয়নি। তারা গুরুত্ব দিয়েছে রাজনীতিকে। তারা কেন শিক্ষা নিয়ে ভাবেনি? কারণ, তাদের ছেলেমেয়ে তো এখানে পড়াশোনা করে না, তারা থাকে বিদেশে। যার কারণে তারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধারণ করেন না।” - ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ, অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি।

বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অনুপস্থিতির হার ২০–২৫ শতাংশ। এতে বাজেটের প্রায় এক চতুর্থাংশ নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের অনুপস্থিতির কারণে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থান এই তালিকায় সবচেয়ে খারাপের মধ্যে একটি। এর ফলে শুধু অর্থই নষ্ট হচ্ছে না, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসও ধ্বংস হচ্ছে।

অন্যদিকে, ঢাকার কিছু স্কুলে আধুনিক সুবিধা যেমন কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও গ্রামীণ এলাকার অনেক স্কুলে টয়লেট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। ২০২৫ সালের একটি ইউনেস্কো রিপোর্টে দেখা গেছে, গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ শতাংশে সুরক্ষিত এবং পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা নেই। বিশেষত, মেয়েরা এই সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখোমুখি হয়। কম স্টাফ থাকা স্কুলগুলোতে তারা আরও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং অনেকেই শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়।

দেশে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ ব্যবস্থাতেও বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে। ২০২৪ সালের একটি তদন্তে দেখা গেছে, ভুল বই ছাপানো, গোপন চুক্তি এবং কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। বই বিতরণে বিলম্ব এবং অনিয়মের কারণে, বছরের শুরুতে অনেক স্কুল–শিক্ষার্থীই পুরো সেট বই পায় না, যা শিক্ষার মান ও নিয়মিত পাঠাভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

গবেষণা খাতেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। দেশের কর্মশক্তি অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে মেলে না। সরকারি বাজেটের ৬০–৭০ শতাংশ বেতন খাতে ব্যয় হয়, যেখানে গবেষণায় হয় ৫ শতাংশেরও কম।

২০২৫ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক (গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স–জিআইআই) অনুযায়ী, ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে ১০৬তম স্থানে (১০০তে স্কোর মাত্র ২১), যা ২০২৪ সালের জায়গাতেই আছে। বাংলাদেশ ঘানা (১০১তম) এবং কেনিয়ার (১০২তম) থেকেও পিছিয়ে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান সর্বশেষ। দেশে নতুন আবিষ্কার বা হাই-টেক রপ্তানিও খুব সীমিত। পাঠ্য-পুস্তকগুলো প্রায়ই পুরোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করায় সমস্যা সমাধান ও কম্পিউটার দক্ষতা শেখানোর সুযোগও মিলছে না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি ১৯ দশমিক ৪ লাখ তরুণ-তরুণীর না আছে চাকরি, না স্কুল। কাজ না থাকার কারণে তাদের স্বপ্ন থমকে গেছে। ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, প্রতি ১৪ জন তরুণ শ্রমিকের একজন এই অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি আছে। তাদের বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত স্নাতক সনদ এখন যেন মূল্যহীন। পাশাপাশি, দেশেও প্রতি বছর বাড়ছে সামগ্রিক বেকারত্বের হার।

দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ২৫ বছরের নিচে, এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের সম্পদ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তনের প্রস্তুতির সময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।

বিষয়টি মতামত জানতে কথা হয় শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার মান বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে ভালো শিক্ষক, মানসম্মত কারিকুলাম, প্রয়োজনীয় বাজেট, ফেসিলিটিজ এবং উপযুক্ত পরিবেশসহ অনেক কিছুর ‍ওপর। এসব ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে শিক্ষার মান স্থানীয় কিংবা বৈশ্বিক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে বিবেচনা করলে প্রশ্ন আসতে পারে যে, প্রাথমিক ও ইংলিশ মিডিয়াম বা কিন্ডারগার্টেনের মান কী সমান? ক্যাডেটের পড়াশোনার কোয়ালিটি আর মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের কোয়ালিটি কী সমান? উত্তর নিশ্চয়ই আসবে, সমান নয়। কারণ, ক্যাডেট স্কুল বা কলেজের সুযোগ-সুবিধা, প্রশাসনিক মডেল, ফান্ডিং সবকিছুই ভাল। সেখানে মনিটরিং আছে, জবাবদিহিতা ও সবকিছুতে স্বচ্ছতা আছে।

এ শিক্ষাবিদের মতে, তারা যেকোনো মূল্যে কোয়ালিটি নিশ্চিত করছে। কিন্তু তার বিপরীতে সরকারি বা বেসরকারি মাধ্যমিক বা সরকারি মাধ্যমিকে কিংবা মাদ্রাসায় ওই ধরনের শিক্ষক, ফান্ডিং, জবাবদিহিতা, রিসোর্স, ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ নেই। একইভাবে, দেশ একটি হলেও শহর-গ্রাম বেসিসেও শিক্ষার মানে তারতম্য রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো কেমন, জবাবদিহিতা আছে কিনা, তারা ঠিকঠাক ক্লাসে যান কিনা, পড়ান কিনা, তাদের মনিটরিং আছে কিনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা কেমন, এসব শর্ত বিবেচনায় আসলে শিক্ষার মান আমাদের দেশে ভাল হচ্ছে না। যদি ভালই হতো তাহলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ অনেক অফিসারই তাদের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়িয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াতেন। রাজধানী বা অন্যান্য শহরের মানুষেরাও তাদের সন্তাদেরকে সরকারি স্কুলে না দিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে দিচ্ছেন।

এ শিক্ষাবিদ মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতার পর্যাপ্ত অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, যারা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে তাদের অনেকেই হয়তো জবাবদিহিতার বাইরে আছেন।

ঢাবির এ শিক্ষক বলেন, গ্লোবাল কন্টেক্সট অনুযায়ী বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষার মান আশেপাশের দেশের তুলনায় কম। কারণ, একটা সময় ছিল এ প্লাসের সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। কিন্তু এটা বিবেচ্য যে, আমি যাকে যে মার্ক দিচ্ছি, সেটার যোগ্য সে কিনা। আমরা আমাদের দেশের এসএসসি, এইচএসসি কিংবা এ এবং ও লেভেলের গ্রহণযোগ্যতা গ্লোবাল লেভেলে আছে কী? অনেক সময় এর জবাবে আসবে ‘নেই’। কারণ, এগুলো গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতে পারেনি। সুতরাং, শিক্ষায় গ্লোবালি স্ট্যান্ডার্ডারাইজ করার বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা। কিন্তু সরকার সেটিতে গুরত্ব দেয়নি। তারা গুরুত্ব দিয়েছে রাজনীতিকে। তারা কেন শিক্ষা নিয়ে ভাবেনি? কারণ, তাদের ছেলেমেয়ে তো এখানে পড়াশোনা করে না, তারা থাকে বিদেশে। যার কারণে তারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধারণ করেন না।  

একই ইনস্টিটিউটের আরেক জেষ্ঠ্য অধ্যাপক ড. এস. এম. হাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে এবং যে পর্যায়ে থাকা প্রয়োজন সে পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, এটা সত্যি। কিন্তু সার্বিক দিক থেকে ভাল করার জন্য সংশ্লিষ্টরা আগের চেয়ে বেশি কনসার্নড রয়েছে। তারা কাজ করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বৈশ্বিক বিবেচনায় খুব একটা ভাল অবস্থানে নেই। এর একটি কারণ, আমরা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাল বা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছি না, যারা কারিকুলাম নিজেরা ভাল বুঝে এবং শিক্ষার্থীদের বুঝাতে পারেন। আর নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকের নিজেদেরই ঘাটতি থাকে, তাহলে তারা অন্যের ঘাটতি কীভাবে পূরণ করবে? এক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিয়োগে গ্রেড বাড়াতে হবে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষাজীবনে সবচেয়ে ভাল করেছে এমন ব্যক্তিদের নিতে হবে এবং তাদেরকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ঘাটতি অনেকটা পূরণ হয়, কারণ ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। কিন্তু স্কুল লেভেলে হচ্ছে উল্টোটা। অতএব, ভাল শিক্ষক নিয়োগ না হলে মানও বাড়বে না।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা খাতে আমাদের দেশের বাজেট একদমই পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে, স্কুল কলেজ পর্যায়ে যোগ্য শিক্ষকদেরকে মূল্যায়ন করতে গেলেও অনেক বাজেটের প্রয়োজন। তখন সে শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে যাবেন জীবন্ত বই রিসোর্স। প্রাইমারি স্কুলেও প্রফেসর হোক, সমস্যা নেই তো। কারণ, এ ধাপটিই শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কল্যাণের জন্য আরও অনেক বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করতে পারে সরকার। আর বরাদ্দকৃত বাজেটকে অবশ্যই পরিকল্পিত উপায়ে সুষমভাবে বণ্টন করতে হবে।

সূত্র: দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়