দেশের সার্বিক পণ্যের পাশাপাশি গত তিন মাস ধরে টানা কমছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। এর কারণ মূলত কয়েকশ’ কারখানা বন্ধ হয়েছে। একইসঙ্গে ক্রেতারাও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রেতাদের আস্থার সংকট ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ইস্যুও রয়েছে। সবমিলিয়ে বড় বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেয়া থেকে সরে যাচ্ছে। এসব কারণে পোশাক রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের আশঙ্কা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আদেশ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক। শুল্কের প্রভাবে বেশির ভাগ ক্রেতা নতুন করে অর্ডার দিচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অনেক বেশি শুল্কের কারণে চীনসহ প্রতিযোগী অনেক দেশ অত্যন্ত কম দামে ইইউতে রপ্তানি করছে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্রেতা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণও মনে করছে। এ কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি কমছে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের একটি শীর্ষ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের অর্ডার বাতিল করেছেন, যা খুবই অ্যালার্মিং। দেশের সার্বিক অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন করে রপ্তানি আদেশ দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সামনে এ সংকট আরও বাড়তে পারে।
অর্ডার হ্রাস: রপ্তানি আদেশের পরিস্থিতি বোঝা যায় ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি’র তথ্যে। এই ইউডি সনদ সরকারের পক্ষে পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ দিয়ে থাকে। দুই সংগঠন থেকে সংগ্রহ করা ইউডি’র তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবর মাসে রপ্তানি আদেশ কম এসেছে ৩৯ কোটি ডলার। অক্টোবরে মোট ২২০ কোটি ডলারের অর্ডার এসেছে। সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ২৪৫ কোটি ডলার। অক্টোবরে ঢাকা অঞ্চলের কারখানাগুলোর রপ্তানি আদেশ আগের মাসের চেয়ে কমেছে ১৫ শতাংশ। ইস্যু করা এসব কারখানায় প্রায় ২১০ কোটি ডলারের আদেশ এসেছে। আগের মাসের চেয়ে যা ৩৫ কোটি ডলার কম। অক্টোবরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানাগুলোর রপ্তানি আদেশ কমেছে ২৬ শতাংশ। আদেশ এসেছে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের। আগের মাসে যা ছিল ১৪ কোটি ডলার।
বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ডনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ইস্যুতে জুলাই ও আগস্টে আমাদের রপ্তানি খাত কিছুটা চাপে ছিল। সেটির প্রভাব সেপ্টেম্বরেও কিছুটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অক্টোবরে এসে আমাদের রপ্তানি এতটা কমে যাওয়া অবশ্যই অ্যালার্মিং। এ বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া দরকার।’
কারখানা বন্ধ: বিজিএমইএ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে সাভারে, যেখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, এর মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে এবং ৯২টি অস্থায়ীভাবে। প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন ও সাফওয়ান আউটারওয়্যারের মতো বড় কারখানাও রয়েছে। গাজীপুরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন, যেখানে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতার বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তো শ্রমিকরাও অংশ নিয়েছিলেন। বৈষম্য নিরসন হয়নি। উল্টো কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাচ্ছেন।
টানা কমছে পোশাক রপ্তানি: রপ্তানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক থেকে আসে। টানা তিন মাস ধরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮.৩৯ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৩০২ কোটি ডলারের পোশাক, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার। অর্থাৎ একক পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানিই কমেছে ২৮ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে পোশাকের রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ২৮৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩০১ কোটি ডলার। আগস্টে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ। আগস্টে রপ্তানি হয়েছে ৩১৬ কোটি ডলারের পোশাক, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩২৫ কোটি ডলার।
ইপিবি’র তথ্যমতে, অক্টোবরে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৩৩ শতাংশ। আর নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ১০.৭৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের অক্টোবরে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৪৩ কোটি ডলারের। এ অর্থবছরের অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছে ১৩৬ কোটি ডলারের। সেপ্টেম্বরে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৫৪ শতাংশ। আর নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৭৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১২৮ কোটি ডলারের। এ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ১২০ কোটি ডলারের। আর নিট পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে। এ অর্থবছরে ১৬৩ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে। এর আগের মাস আগস্টে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ২.৬৫ শতাংশ। আর নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ৬.৩৪ শতাংশ।
বিজিএমইএ’র মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সরবরাহ স্থিতিশীলতা ও আস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। গত এক বছরে ২৫৮টি কারখানা তাদের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে এক লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে ক্ষুদ্র বা মাঝারি পরিসরে টিকে থাকার চেষ্টা করছে; কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিদ্যুৎসংকট, মজুরি সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’ তবে একই সময়ে নতুন ১৬৬টি কারখানা চালু হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি সক্ষমতা উভয়ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে কারখানা বন্ধ হতে থাকে, তাহলে অনেক ক্রেতা বিকল্প দেশ যেমন-ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারেন।’
অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ইইউর ২৭ দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছিল ৫৮ শতাংশ। একই সময়ে ইইউতে চীনের পোশাক রপ্তানি কমে যায় ৪ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান কার্যালয় ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। পরিমাণ ছিল ১৩.৪৮ বিলিয়ন ইউরো। এ সময় চীনা পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৭ শতাংশের বেশি। পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ বিলিয়ন ইউরো।
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, অস্বাভাবিক হারে বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। ভারতসহ এ রকম কিছু দেশের সঙ্গে এখনো আলোচনা চলছে। সবমিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনো স্থিতিশীলতা আসেনি। বাড়তি শুল্ক আদায়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দর বেড়েছে। উৎস: মানবজমিন।