রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) স্থিতিশীলতা ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল শেষে বিওপির ঘাটতি নেমে এসেছে ৬৬ কোটি ডলারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সূচকে ৬৫৭ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিওপির ঘাটতি ছিল ৮২২ কোটি ডলার।
বিওপির ঘাটতি হলে সেটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে পূরণ করতে হয়। গত তিন অর্থবছর ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বড় ঘাটতিতে বাংলাদেশ। এ কারণে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ পরবর্তী তিন বছরে অর্ধেকে নেমে আসে। তবে বিওপির ঘাটতি বর্তমানে কমে আসায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে না। এ কারণে স্থিতিশীল রয়েছে দেশের রিজার্ভ।
দেশের ডলার প্রবাহ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, যা বিওপি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি বিওপির সর্বশেষ প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) প্রবাসীরা রেকর্ড ২ হাজার ৪৯৩ কোটি বা ২৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসীদের পাঠানো এ বাড়তি অর্থেই সরকারের চলতি হিসাবে ও সামগ্রিক লেনদেন ঘাটতি কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এপ্রিলের পর মে মাসেও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি রফতানি খাতও প্রবৃ্দ্ধির ধারায় রয়েছে। এর মধ্যে গত মাসে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। সরবরাহ ভালো থাকায় তা স্থিতিশীল রয়েছে।
এদিকে জুনের মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পাওয়ার কথা রয়েছে। এ ঋণ যোগ হলে দেশের বিওপি ইতিবাচক ধারায় চলে আসার পাশাপাশি রিজার্ভেও বড় ধরনের উন্নতি লক্ষ করা যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান দাবি করেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরজুড়ে ডলারের যে সংকট ছিল, সেটি এ মুহূর্তে পুরোপুরি কেটে গেছে। ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী স্বাচ্ছন্দ্যে আমদানির এলসি খুলতে পারছেন। ডলারের বিনিময় হারও পুরোপুরি স্থিতিশীল। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আশা করছি চলতি অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সবক’টি সূচকে দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ মে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। জুনে বড় কোনো পেমেন্টের চাপ নেই। এ কারণে পুরো জুনেই রিজার্ভের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের আমদানি ব্যয় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ ব্যয় ছিল ৫২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৫৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রফতানি আয়ে। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রফতানি আয় এসেছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। রফতানিতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবাসী আয়ও ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।
রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ওপর ভর করে কমেছে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৬০২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ১৩৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আর এপ্রিল পর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১৯৬ কোটি ডলার। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদেশী অনুদান ও বিদেশী ঋণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ সবক’টি নির্দেশকেই অবশ্য ডলার প্রবাহ কমেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিদেশী বিনিয়োগ ও অনুদান বাড়ানোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। উৎস: বণিক বার্তা।