শিরোনাম
◈ কালীগঞ্জে বিদেশী পিস্তল সহ একাধিক মামলার আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী ঘ্যানা গ্রেফতার ◈ আজও বিদ্যুৎবিহীন জীবন: নিম্নমানের সোলারে বিপাকে কুড়িগ্রামের দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ ◈ জুলাই-আগস্ট হত্যায় রাজসাক্ষী হলে মামুনকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমার ইঙ্গিত ◈ যেখানেই মব জাস্টিস সেখানেই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে: রিজওয়ানা হাসান ◈ চাঁদাবাজির তথ্য মেলেনি, ভাঙারি দোকান দখল নিয়ে দ্বন্দ্বেই মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড: বলছে ডিএমপি ◈ মার্কিন শুল্ক হুমকির মুখে বাংলাদেশে কিছু পোশাক অর্ডার স্থগিত করেছে ওয়ালমার্ট ◈ চট্টগ্রামে স্ত্রীকে ১১ টুকরা করা স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেফতার ◈ টি-‌টো‌য়ে‌ন্টি বিশ্বকা‌পে কীভা‌বে আস‌লো ফুটব‌লের দেশ ইতালি  ◈ রা‌তে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনা‌লে পিএস‌জি ও চেল‌সি মু‌খ্মেু‌খি ◈ মিটফোর্ড পাথরকান্ড: ওই ঘটনার সঙ্গে বিএনপি জড়িত কোথায়?: রিজভী 

প্রকাশিত : ১২ জুলাই, ২০২৫, ০১:১৯ রাত
আপডেট : ১২ জুলাই, ২০২৫, ০৭:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার নেপথ্যে যা জানাগেল

নিহত ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ

রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বইছে। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই এলাকা থেকে ৬ লাখ টাকা করে চাঁদা তুলতেন তিনি। সম্প্রতি চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ নির্ধারণ করে মহিনকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি সোহাগ জানার পর ইসহাক গ্রুপের হাত থেকে বাঁচতে লালবাগের আরেক বিএনপি নেতা হামিদুর রহমান হামিদের গ্রুপে সম্পৃক্ত হতে চেষ্টা চালান। এতে খেপে যান ইসহাক এবং সোহাগকে হত্যার জন্য মহিনকে কাজে লাগান।

এরপরই বুধবার সন্ধ্যার দিকে মিটফোর্ড এলাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথরের আঘাতে নৃশংসভাবে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যা করা হয়। এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন—যুবদল নেতা মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন। বাকি দুজনের নাম এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ প্রকাশ করেনি। বিষয়টি নজরে আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে দলের জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে যুবদল নেতা রজ্জব আলী পিন্টু ও সাবাহ করিম লাকিকে দল থেকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নিন্দা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এছাড়া হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা, জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীসহ সর্বস্তরের জনতা। 

নেপথ্যে বিএনপি নেতা ইসহাকের চাঁদাবাজি

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। চব্বিশের গণ-অভু্যত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিএনপি নেতা ইসহাক এই চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নেন। 

তিনি এতদিন ধরে সেখান থেকে তার লোকজন দিয়ে মাসিক ৬ লাখ টাকা করে চাঁদা তুলতেন। সোহাগ সবার কাছ থেকে এ টাকা সংগ্রহ করে তাকে দিতেন। এর মধ্যে সম্প্রতি চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেন ইসহাক। সেইসঙ্গে চাঁদা তোলার দায়িত্ব থেকে সোহাগকে সরিয়ে দেওয়া হয় মাহমুদুল হাসান মহিনকে।

বিষয়টি জানতে পেরে সোহাগ স্থানীয় আরেক প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হামিদের গ্রুপে ভেড়ার চষ্টো করেন। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে সোহাগকে হত্যার জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করা হয়। বিএনপি নেতা ইসহাকের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় মহিন গ্রুপর লোকজন। 

জানা গেছে, বুধবার সন্ধ্যার দিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তিনি কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পূর্ব নামাবাড়ি গ্রামের ইউসুফ আলী হাওলাদারের ছেলে। এ ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।

আসামিরা হলেন—মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদার। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, সোহাগ দীর্ঘদিন ওই এলাকায় ব্যবসা করায় ব্যবসায়িক বিভিন্ন বিষয়সহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আসামিদের সঙ্গে তার বিরোধ চলে আসছিল। এর জের ধরে তারা সোহাগের ভাঙারি ব্যবসার গুদাম তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেই সঙ্গে তাকে এলাকাছাড়া করতে নানারকম ভয় দেখিয়ে আসছিলেন। মূলত এ শত্রুতা থেকে তাকে হত্যা করা হয়।

গ্রেফতার ৪, রিমান্ডে ২

ডিএমপির মিডিয়া বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে। এছাড়া র্যাব গ্রেফতার করে আরও দুজনকে। যাদের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করেছে।

আদালত সূত্র জানায়, গ্রেফতার মহিনের পাঁচদিন এবং রবিনের দুদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা এ আদেশ দেন। আদালতে কোতোয়ালি থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) তানভীর এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়েছে।

জড়িতরা যুবদল-ছাত্রদল ও মিটফোর্ডের কর্মচারী

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অন্তত ৬ জনের সংশি্লষ্টতা নিশ্চিত হয়ে তাদের পরিচয় বের করেন। এর মধ্যে সরোয়ার হোসেন টিটু চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সদস্য। তার বাসা কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায়। অপু দাস চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মনির হোসেন মিটফোর্ড হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন এবং নান্নু অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আসামিরা মিটফোর্ড হাসপাতালে নম্নিপদের কর্মচারীসহ বিভিন্ন অস্থায়ী পদে চাকরিতে নিয়োগ, ওষুধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি ও ফুটপাত থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা আদায় করে আসছেন। আসামিদের সঙ্গে মিটফোর্ড হাসপাতালের জনৈক পরিচালক এবং বিএনপি নেতা মরহুম নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনার সঙ্গে ছবি দেখা গেছে।

সিসিটিভি ফুটেজে মিলেছে আদিম নৃসংশতা

ফুটেজে দেখা যায়, সোহাগকে হত্যার পর তার লাশের ওপর চলতে থাকে ভয়াবহ আদিম নৃশংসতা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উন্মত্ত উল্লাস করতে থাকে খুনিরা। ভারী পাথর তুলে তার শরীর ও নাকে-মুখে আঘাত করতে থাকে। তার শরীর থেকে একটি ছোট প্যান্ট ছাড়া সব খুলে নেওয়া হয়। ওই সময় আশপাশে শত শত লোক দাঁড়িয়ে থাকলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে যাননি।

জড়িতদের আজীবন বহিষ্কার

সোহাগকে হত্যার ঘটনায় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রদলের অভিযুক্ত সদস্যদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। শুক্রবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এমনটা জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনোদিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’।

অন্যদিকে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ুবিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।

একই সঙ্গে আইশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনোরূপ শৈথিল্য না দেখিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে দলটি জানায়, বহিষ্কৃত নেতাদের কোনো ধরনের অপকর্মের দায়দায়িত্ব দল নেবে না। যুবদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তাদের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিচ্ছিন্ন এ ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি। এটা নোংরা রাজনীতির চর্চা।

জামায়াতের উদ্বেগ ও নিন্দা

এ হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শুক্রবার রাতে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে মাথায় পাথর মেরে শত শত মানুষের সামনে এই হত্যার ঘটনা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। 

এ নির্মম দৃশ্য জাহেলিয়াতের লোমহর্ষক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতাকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশবিক এই হত্যার ঘটনায় মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এভাবে পাশাবিক কায়দায় মানুষ হত্যা সভ্যসমাজে বিরল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল। 

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এছাড়া পৃথক বিবৃতিতে এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচার দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণসংহতি আন্দোলন। সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়